স্টিভ টিকোলো: দ্য ওয়ান ম্যান আর্মি

কিংবদন্তি হতে আর কি কি লাগে আমার জানা নেই, অথবা বিশ্বক্রিকেট তাকে কিংবদন্তির তকমা দেবে কিনা সেটাও আমি জানি না, তবে কেনিয়ান ক্রিকেট আকাশে তিনি থাকবেন সূর্য সমান দীপ্তি নিয়ে। একটি দেশের ক্রিকেট ইতিহাস জুড়ে একজন মানুষের এতটা প্রভাব খুঁজে পাওয়া বিরল। গ্রেটদের নামের সাথে তার নাম উচ্চারিত হোক বা না হোক, কিংবদন্তীর সন্মান তিনি পান বা না পান, কেনিয়ান ক্রিকেটে তিনি থাকবেন একজন জাতীয় বীর হয়ে।

উইলস ওয়ার্ল্ড কাপ ১৯৯৬, তারিখটা ১৮ ফেব্রুয়ারি। আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে কোটাকের বারাবাটি স্টেডিয়ামে সেদিন মাঠে নেমেছিল ভারত। আয়োজক দেশ হিসাবে শিরোপা প্রত্যাশী ভারতের সামনে সহযোগী দল কেনিয়া। ম্যাচের ফলাফল নিয়ে কারো মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না, এবং সেটার প্রমান হিসাবে লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকারের অপরাজিত সেঞ্চুরিতে সাত উইকেটের জয় তুলে নিয়েছিল ভারত। না, ওই ম্যাচের ম্যান অব দ্যা ম্যাচ শচীন রমেস টেন্ডুলকার আমার এই গল্পের নায়ক নন, আমার এই গল্পের নায়ক ওই ম্যাচে অভিষিক্ত হওয়া ক্রিকেটার ‘গানস’।

পুরো নাম স্টিফেন ওগোনজি টিকোলো, তবে সতীর্থদের কাছে পরিচিত ছিলেন গানস (বন্দুক) নামে। বর্তমান ক্রিকেটের মত অভিষেকের আগেই মাতামাতি বা কাটাছেঁড়ার প্রচলন সেই আমলে ছিল না, আইসিসির সহযোগী দেশের একজন ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে তো নয়ই। তার অভিষেক নিয়ে মিডিয়া পাড়ায় কোন হইচই ছিল না, তবে সময়ের সাথে সাথে হইচঁই তাকে নিয়ে কম হয়নি, তিনি বারবার বাধ্য করেছেন।

ভারতের বিপক্ষে ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপের মত একটি আসরে অভিষেক! তিন নম্বরে যখন ব্যাট করতে নামলেন, তখন তার কপালে ঘামের চিহ্ন থাকার কথা, রক্তে অ্যাড্রোনালিনের মাত্রা বেড়ে যাবার কথা কয়েকগুন কিন্তু তিনি ছিলেন ইস্পাত শীতল! অবলীলায় খেলেছেন ৬৫ রানের এক ঝঁকঝকে ইনিংস।

দল হেরেছে, কিন্তু তিনি জিতেছেন মন। অবশ্য তার ওই ইনিংসকে ফ্লুক বলে উড়িয়ে দেবার লোকের অভাব ছিল না। জবাবটা দিতেও দেরি করেননি টিকোলো, ওই আসরের চ্যাম্পিয়ন দল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাদেরই মাঠে ৯৫ বলে ৯৬ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংসে মুখ বন্ধ করে দেন সংশয় প্রকাশকারীদের। দল এবারও হেরেছে কিন্তু তিনি জিতেছেন বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের জায়গা। টিকোলোর বিশ্বকাপ ম্যাজিক এখানেই শেষ নয়, কেনিয়ার ইতিহাসে সবথেকে মর্যাদার জয় যে তার হাত ধরেই এসেছিল সেবার।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে তারকার অভাব ছিল না, লারা, অ্যামব্রোস, ওয়ালশদের তোপে উড়ে যাবার বদলে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিল কেনিয়া। কেনিয়ার করা ১৬৬ রানও টপকাতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অলআউট হয়েছিল মাত্র ৯৩ রানে। কেনিয়ার পক্ষে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান ছিল ২৯। ব্যাটসম্যানের নাম নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না!

অভিষেকের পর থেকেই টিকোলোর ব্যাটে ভরসা খোঁজা শুরু হয় কেনিয়া দলের। অনেকটা একা হাতেই সামলেছেন কেনিয়ার ব্যাটিং, কখনো দলের পরিস্থিতি আবার কখনো সমর্থনের অভাবে খেলতে পারেননি নিজের সহজাত খেলা। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে যে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ, সেই বিজয়ের রুপকার হিসেবে অনেকের নামই আমরা জানি। কিন্তু ওই ম্যাচে সত্যিকারের নায়ক টিকোলো হারিয়ে গেছেন দলের হারের ভিড়ে। বাংলাদেশের বিপক্ষে, বোলার মোহাম্মদ রফিক।

কেনিয়ার করা ২৪১ রানের মধ্যে টিকোলো একাই করেছিলেন ১৪৭ রান! হ্যাঁ, সালটা ১৯৯৭ ছিল এবং তৎকালীন সময়ের ক্রিকেট অনুযায়ী এই ইনিংসটা ছিল অতিমানবীয়। বাংলাদেশের পাশাপাশি সেবার কেনিয়াও আইসিসির ওয়ানডে স্ট্যাটাস লাভ করে।

বাংলাদেশের বোলাররা ছিল গানসের সবথেকে প্রিয় প্রতিপক্ষ। সেটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ হোক অথবা ঘরোয়া লিগ। নিজের ক্যারিয়ারের অসংখ্য প্রথমের জন্ম তিনি দিয়েছেন এই লাল সবুজ জার্সি পরিহিত বোলারদের বিরুদ্ধে। নিজের প্রথম সেঞ্চুরি থেকে শুরু করে ২০০৩ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হওয়া, সব ক্ষেত্রেই ভুগিয়েছেন বাংলাদেশী বোলারদের।

ঢাকার ক্রিকেটে টিকোলো পরিচিত ছিলেন কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার হিসাবে। তবে, শুধু বাংলাদেশের বোলারদের একচেটিয়া দোষ দিলে অন্যায় হবে টিকোলোর স্কিল এবং ক্লাসের সাথে। বড় দলগুলোর বিপক্ষেও সমান তালে হেসেছে তার ব্যাট। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ভারত এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফিফটি করেন তিনি। এমনকি, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরাজিত দলের সদস্য হয়েও লাভ করেন ম্যান অব দ্যা ম্যাচের পুরস্কার। আপনি টিকোলোর চেহারা নিয়ে মশকরা করতে পারেন কিন্তু তার ব্যাটিং এলিগ্যান্স নিয়ে নয়।

১৯৯৮ সালে ভারত, বাংলাদেশ এবং কেনিয়ার মধ্যে একটি তিনজাতি ওয়ানডে সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক দেশ ছিল ভারত। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ফিফটি করে দলের জয় নিশ্চিত করেন গানস। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কেনিয়ার জয় তখন কোন অঘটন ছিল না, কিন্তু পরের ম্যাচেই ভারতকে কুপোকাত করে অঘটনের জন্ম দেয় কেনিয়া।

জয়ের নায়ক সেই চিরচেনা, বেঁটে, থ্যাবড়া নাকের দ্যা ওয়ান ম্যান আর্মি টিকোলো। ব্যাট হাসেনি সেদিন, করেছিলেন মাত্র ২১! কিন্তু আঙ্গুল তার জাদু ঠিকই দেখিয়েছিল, মাত্র ২৩ রান খরচায় ভারতের মূল্যবান ৩ টি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। অবাক হচ্ছেন? অবাক হবেন না প্লিজ, কারণ কেনিয়ার ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির নাম স্টিফেন টিকোলো।

২০০২ সালে অধিনায়ক হিসাবে জাতীয় দলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং দক্ষিন আফ্রিকার কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় কেনিয়া। তবে টিকোলোর ব্যাট চওড়া ছিল দুই ম্যাচেই। ব্যাক টু ব্যাক ফিফটি করে আরও একবার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বড় মঞ্চে তার সামর্থ্য। এরপর সেই ঐতিহাসিক ২০০৩ বিশ্বকাপ!

কেনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাস বদলে দেয়া এক টুর্নামেন্ট! সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে তুলে নিয়েছিলেন সেমিফাইনালে! অর্জনটা পাহাড়সম, কিন্তু সেটার আউটপুট ছিল শুন্য। টেস্ট স্ট্যাটাস থেকে মাত্র একধাপ দূরে ছিল কেনিয়া, কিন্তু বোর্ড সদস্যদের দুর্নীতি এবং খামখেয়ালিতে পূরণ হয়নি কুলিন দলের সদস্য হবার সাধ। বোর্ডের দুর্নীতির চাদরে ঢাকা পড়ে যায় টিকোলোর টেস্ট ক্যারিয়ার। চাঁদের কলঙ্কের মত এই একটাই দাগ গানসের ক্যারিয়ারে।

খেলেছেন ২০০৭ এবং ২০১১ সালের বিশ্বকাপও। পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলা বিরল ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনিও একজন। বিশ্বকাপের মঞ্চে টিকোলো ছিল বরাবরই দুর্দান্ত। কিন্তু ২০১১ সালের বিশ্বকাপে অনেক পরিসংখ্যানই পাল্টে যায়। পাঁচ ইনিংসে মাত্র ৪৩ রান কমিয়ে আনে তার বিশ্বকাপ গড়।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ দিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানার ঘোষণা দেন তিনি। ব্যক্তিগত ১০ রানে রেমন্ড প্রাইসের বলে এলবিডব্লিউ এর ফাঁদে পড়েন তিনি। কিন্তু কোন উদযাপন করেনি সেদিন জিম্বাবুয়ের প্লেয়াররা। সবাই একসাথে জমায়েত হয়ে গার্ড অব অনার দেয় টিকোলোকে। তিনি ড্রেসিং রুমে পৌঁছান অবধি করতালি দিয়ে বিদায় জানান প্রাইসরা। একজন কিংবদন্তির জন্য জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের সন্মান দেখানোটা ছিল সেবারের বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ঘটনা।

২০১২ সালে উগান্ডা জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচের দায়িত্ব নেন। কিন্তু ২০১৩ সালে কেনিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের অনুরোধে অবসর ভেঙে জাতীয় দলে ফিরে আসেন দলকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে। চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেন জাতীয় দলের হয়ে, এরপর আবারও চলে যান অবসরে। এরপর পালন করেছেন কেনিয়া অনূর্ধ্ব ১৯ দলের কোচের দায়িত্ব। বর্তমানে উগান্ডা জাতীয় দলের কোচ হিসাবে দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন টিকোলো।

১৩৫টি ওয়ানডে ম্যাচে ৩৫ গড়ে ৩৪২৮ রান এবং সেই সাথে ৯৪টি উইকেট। এমন পরিসংখ্যান টিকোলোর নামকে গ্রেটদের সাথে উচ্চারিত হতে দেবে না। কিন্তু ওই পরিসংখ্যানে লেখা নেই টিকোলোর ক্লাস, ওই পরিসংখ্যানে লেখা নেই টিকোলোর একা লড়াই করে যাবার কথা, ওই পরিসংখ্যানে লেখা নেই একটি দলের বোঝা বইবার ক্ষমতা।

দেশপ্রেমিকের ত্যাগ, কয়েকটি সংখ্যায় খুঁজতে যাওয়াটা অবিচারের সামিল। ১৫ বছরের ক্যারিয়ারের প্রতিটি সময় কেনিয়া ক্রিকেটের মশাল একা হাতে বয়েছেন টিকোলো। বড় দলগুলোর চোখ রাঙানির সামনে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে গেছেন বহুবার। ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসেও বিপক্ষ দলের জন্য তিনিই ছিলেন প্রাইজ উইকেট।

কিংবদন্তি হতে আর কি কি লাগে আমার জানা নেই, অথবা বিশ্বক্রিকেট তাকে কিংবদন্তির তকমা দেবে কিনা সেটাও আমি জানি না, তবে কেনিয়ান ক্রিকেট আকাশে তিনি থাকবেন সূর্য সমান দীপ্তি নিয়ে। একটি দেশের ক্রিকেট ইতিহাস জুড়ে একজন মানুষের এতটা প্রভাব খুঁজে পাওয়া বিরল। গ্রেটদের নামের সাথে তার নাম উচ্চারিত হোক বা না হোক, কিংবদন্তীর সন্মান তিনি পান বা না পান, কেনিয়ান ক্রিকেটে তিনি থাকবেন একজন জাতীয় বীর হয়ে।

কতজন গ্রেট খেলোয়াড় তার দেশের জাতীয় বীরের মর্যাদা পাবেন সেই হিসাব পাঠকদের জন্যই তোলা থাক। তবে টিকোলোর মত টর্চ বিয়ারার আবার কবে নাগাদ কেনিয়ান ক্রিকেটে আসবে অথবা আদৌ আসবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এখানেই টিকোলো অসংখ্য গ্রেট ক্রিকেটারদের থেকে মাইল ব্যবধানে এগিয়ে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...