প্রতিপক্ষের দূর্গে হানা দিয়ে চার বার জয়ী হওয়ার গল্প বোধহয় খুব বিরল ঘটনা। চারটি ভিন্ন আক্রমণে তিন ভিন্ন প্রতিপক্ষের ঘরে হানা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু ২০২১ সালে ভারত তা করে দেখিয়েছে। আরেকটু বিশেষভাবে বললে ভারত ক্রিকেট দল। সাদা পোশাকে, লাল বলের ক্রিকেটে বিশ্ব ক্রিকেটের তিন পরাশক্তিকে তাঁদের ঘরের মাঠেই হারিয়েছে বিরাট কোহলির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় ক্রিকেট দল।
অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা এদের বিপক্ষে তাঁদের দূর্গে হানা দিয়ে জয় তুলে নিয়েছে ভারত। বছরের প্রথম জয়টা এসেছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গ্যাবায়, তারপরের দুইটি ইংল্যান্ডে লর্ডস এবং ওভালে তারপর শেষেরটা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বছরের শেষ টেস্টে তাঁদের রক্ষণ প্রাচীন সেঞ্চুরিয়নে। এসব কিছুই ইতিহাস গড়া একেকটি জয়।
খুব যে সহজে এতগুলো জয় পেয়েছে ভারত তা কিন্তু নয়। প্রতিটা জয়ই ছিল বেশ কষ্টসাধ্য জয়। প্রথমত ভিন্ন কন্ডিশন এর উপর অত কঠিন সব প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জয়। পুরো একটা দল হয়ে পারফর্ম করতে পেরেছে বলেই কিনা ভারত ঐতিহাসিক সব জয় তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুর পেছনে খানিক অবদান ভারতীয় ওপেনারদের তো রয়েছেই। কোন কোন ক্ষেত্রে ওপেনিং পার্টনারশিপগুলোই ম্যাচ জয়ের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। এই যে যেমন বছরের একেবারে শেষের দিকে সেঞ্চুরিয়ন টেস্টের কথা ধরা যাক।
ভারতের প্রথম ইনিংসের ওপেনিং জুঁটিতে ১১৭ রান তুলতে সক্ষম হয় লোকেশ রাহুল ও মায়াঙ্ক আগারওয়াল। ৬০ করে মায়াঙ্ক আগারওয়াল আউট হয়ে গেলেও রাহুল ঠিকই তুলে নিয়েছিলেন শতক। তিনি আউট হয়েছিলেন ব্যক্তিগত ১২৩ রানে। তবে ওই যে ওপেনিং জুঁটিতে দুইজনের তোলা রানটাই জয়ের পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল। শেষেমেশ দক্ষিণ আফ্রিকা হেরেছিলো ১১৩ রানে। এই বছরে সবগুলো দেশের বাইরের জয়ে অধিকাংশ সময়ই ভারতের ওপেনিং জুঁটির বড় একটা পার্টানারশিপ অবদান রেখেছে।
ব্যতিক্রম শুধু গ্যাবায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলা টেস্ট ম্যাচ। বাকি প্রতিটা টেস্টের কোন না কোন ইনিংসে ওপেনিং জুঁটির একটা বড় সংগ্রহ ছিলো। তবে এই যে সাফল্যের পেছনে থাকা সফল ওপেনার রাহুল ও মায়াঙ্কের সাথে রোহিত শর্মা এরা কেউই স্বীকৃত পুরোদস্তুর টেস্ট ব্যাটার নয়।
প্রত্যেকেই সাদা বলের ক্রিকেটের মারকুটে ব্যাটার। যারা কিনা মাঠের চারিদিকে শট খেলতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সুতরাং সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি ফরম্যাটে নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়ার কাজটা বেশ ভালই করেছেন রাহুল, মায়াঙ্ক ও অভিজ্ঞ রোহিত। নিজেদের সংযত রেখে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাঘাবাঘা সব পেসারদেরকে দিব্যি সামলে নিচ্ছেন তাঁরা।
নিজেদের এই মানিয়ে নেওয়ার বিষয়ে রাহুল বলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটে বল ছেড়ে দেওয়াটা ইনজয় করা শিখতে হবে। হ্যাঁ, এটাও ঠিক মাঠের চারপাশে সজোড়ে বল পাঠানোতেও আলাদা একটা রোমাঞ্চ কাজ করে, কিন্তু টেস্টে বল ছেড়ে দেওয়া একটি দক্ষতা যেটা কিনা আমাকে শিখতে হয়েছে।’
হ্যাঁ, টেস্ট ক্রিকেটে একটি উইকেটের বেশ একটা মূল্য রয়েছে। একটা দশ কিংবা বারো ওভারের স্পেলে একজন বোলার একজন ব্যাটারকে আউট করার ধারাবাহিক কাজের একটি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করেন। এ সময় বোলারের পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেওয়ার জন্যে ভাল বলকে সমীহ করা কিংবা বেশি দূরের বল না খেলাও একটা ক্রিকেটীয় শৈলী একটি দক্ষতা।
ভারতীয় ওপেনাররা বেশ ভাল ভাবেই রপ্ত করেছেন বল ছেড়ে দেওয়ার এই দক্ষতা। এ বিষয়ে ভারত জাতীয় নারী দলের সাবেক কোন ওয়ার্কেরি রামন বলেন, ‘প্রথমেই নজড়ে আসবে ইংল্যান্ড সফর থেকেই ভারতীয় ওপেনারদের প্রচুর পরিমাণ বল ছেড়ে দেওয়ার এবং শরীরের কাছাকাছির বলগুলো খেলার প্রবণতা। তাঁরা তাঁদের ড্রাইভ খেলার সহজাত প্রবৃত্তিকে সংযত রেখে এডজ হওয়ার সম্ভাবনাকে কমিয়ে এনেছে।’ ভারতের নতুন কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের সংযুক্তির পর ওপেনারদের মধ্যে এই দক্ষতা অর্জন বা এই বল ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা আরো প্রবল হয়েছে।
রাহুল দ্রাবিড় তাঁর খেলোয়াড়ি সময়ে অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটারদের একজন ছিলেন। তিনি জানেন কি করে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতিতেও নিজের উইকেটটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সেই টোটকাই হয়ত তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর শীর্ষদের। তাছাড়া মায়াঙ্ক অকপটে এই কথাও বলেছেন যে দ্রাবিড়ের নির্দেশনাও নাকি রয়েছে যে দলের প্রয়োজনে নোংরা ক্রিকেটীয় দর্শন প্রদর্শনে যেন কার্পণ্য না করে ব্যাটার না।
মায়াঙ্ক বলেন, ‘কোচ আমাদেরকে বলেছেন যে যখন তোমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলবা তখন প্রায়শই তোমার ব্যাটিং খুব বেশি দৃষ্টিনন্দন হবে না। কিন্তু দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে অটল থাকা নিজের পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলায় এবং এর সাথে যতটা সম্ভব বল ছেড়ে দিয়ে স্কোর বোর্ডে রান তোলা।’
অতএব বোঝাই যাচ্ছে পুরোদস্তুর টেস্ট মানসিকতার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে ভারতে ব্যাটিং লাইন আপ, বিশেষ করে ওপেনাররা। এখন দেখবার বিষয় রাহুল দ্রাবিড়ের অধিনে নতুন এক বছরের ভিন্ন ফরম্যাটে ভারত কেমন পারফর্ম করে আর তাঁর ওপেনাররাই বা কি করে।