ভরসার দেওয়াল, ওয়ানডেতেও!

ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট ব্যাট মনে করলেই সুনীল গাভাস্কার, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, দিলীপ ভেঙসরকার এবং তৎপরবর্তীকালে শচীন টেন্ডুলকার যুগের সেরা টেস্ট ব্যাটার রাহুল দ্রাবিড় অবশ্যই আলোচনায় থাকবেন। রাহুল দ্রাবিড় এবং টেস্ট ম্যাচ সমার্থক। নিজের জীবন বাজি রেখে কাউকে ব্যাট করতে পাঠাতে হলে শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি কিংবা বিরাট কোহলির আগে সবাই রাহুল দ্রাবিড়ের নামটাই বলবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু, গোটা ক্যারিয়ার জুড়ে তাঁকে শুনতে হয়েছে ওয়ানডেতে অচল, মন্থর ব্যাটিং করেন, ম্যাচ উইনার নন। টেস্ট ম্যাচে সবচেয়ে বেশি বল খেলার বিশ্বরেকর্ড আছে ওঁর, কিন্তু ওয়ান ডে তে? একদমই কি জেতান নি ম্যাচ? আজকে আমার দেখা, প্রায় অনালোচিত একটি রাহুল দ্রাবিড়ের ওয়ানডে ইনিংস নিয়ে দুচার কথা একটু বলে যাই।

২০০২ সালের নভেম্বর মাস, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ভারতের মধ্যে সাত ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের চতুর্থ ম্যাচ আহমেদাবাদে (আজকাল আর এরকম লম্বা ওয়ান ডে সিরিজ হয়না বললেই চলে )। পুজোর ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে গেছি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোস্টেলে। সেই সিরিজটি সম্ভবত ভারতে কার্ল হুপারের শেষ সিরিজ, তিনি অধিনায়কও ছিলেন।

এরপরে তিনি ২০০৩ বিশ্বকাপ খেলে অবসর নেবেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই সময়ে দুর্ধর্ষ ব্যাটিং লাইন আপ, গেল, সারওয়ান, স্যামুয়েলস সবাই দুরন্ত ছন্দে আছেন। ভারত অপ্রত্যাশিতভাবে সিরিজে ০-২ পিছিয়ে পড়ে তৃতীয় ম্যাচ জিতে ১-২ পিছিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আগে ব্যাট করে পাহাড়প্রমাণ ৩২৪ রান তুলে ফেলে গেলের ঝোড়ো ১৪০ রানের সৌজন্যে, যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন সারওয়ানও (৯৯)।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং খুব শক্তিশালী না হলেও একেবারে ফেলে দেবার মতো ও ছিলোনা। মার্ভিন ডিলন, পেদ্রো কলিন্স, ভাসবার্ট ড্রেক্স ছিলেন। স্পিনে ছিলেন হুপার নিজে আর নাগমুত্তু। সচিন সম্ভবত চোটের কারণে সেই ওয়ান ডে সিরিজে ছিলেন না।

ক্লাস থেকে এসে দেখতে বসেছি খেলা, বন্ধুদের সঙ্গে। আপাতদৃষ্টিতে ভারতের হারার কথা, যদি না শেবাগ আর সৌরভ ওপেনিংয়ে একটা ধামাকাদার কিছু করেন। তো তাঁরা সেটাই চেষ্টা করেছিলেন। প্রথম ওভারেই অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে শেবাগ একটা বাউন্ডারি মেরে আউট, এবং ম্যাচের ষষ্ঠ ওভারে সৌরভ মাত্র ১৬ বলে ২৮ রান করে পেদ্রো কলিন্সের বলে আউট। রান রেট যদিও তখন সাতের উপরে, কিন্তু ভারতের মিডল অর্ডারে সেদিন ভিভিএস লক্ষণ, দ্রাবিড়, ব্যাঙ্গারের মতো সব ‘টেস্ট’ ছাপ মারা প্লেয়ার।

হ্যাঁ, যুবরাজ সিং কিংবা মোহাম্মদ কাইফও আছেন, কিছুদিন আগেই ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালের সেই অবিশ্বাস্য জার্সি ওড়ানো জয় এনে দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও একটা দুর্দান্ত ওপেনিং ছিল বীরেন্দ্র শেবাগ আর সৌরভের। এখানে দল ৪৫/২ এমন অবস্থা থেকে খেলাটা ধরলেন সেই ইডেন খ্যাত লক্ষণ আর দ্রাবিড়। দ্রাবিড় শুরুতে স্বভাবসিদ্ধভাবে দেখেশুনে খেলতে শুরু করেন, অন্যদিকে লক্ষণ মাঝে মাঝে বাউন্ডারি মেরে স্কোরবোর্ড সচল রাখছিলেন।

সৌরভের শুরুর আক্রমণের ফল হিসেবে রান রেট বেশ অনেক্ষন ছয় এর উপরেই থেকে যায় ভারতের। ১০৩ রানের একটা অমূল্য পার্টনারশিপের পরে লক্ষণ ৭৪ বলে ৬৬ করে আউট হন। নিশ্চুপে দ্রাবিড় ততক্ষণে ৪১ এ পৌঁছে গেছেন। এরপরে এলেন যুবরাজ, আবারো তিনি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন দুরন্ত স্ট্রোক প্লে-তে ৩০ বলে ৩০ করে। কিন্তু তিনিও দলের ২০১ রানের মাথায় ডিলনের বলে আউট, দ্রাবিড় কিন্তু সবার অলক্ষ্যে হাফ সেঞ্চুরি পুরো করে ৬৪ রানে পৌঁছে গেছেন।

এরপর কাইফ নামলেন, বেশিক্ষণ টিকলেন না। এবার নামলেন সঞ্জয় ব্যাঙ্গার। আমরা ততক্ষনে জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছি কেননা বাঙ্গারকে কোনোদিন সেভাবে মারতে দেখিনি। প্রায় একশোর কাছে রান বাকি, আস্কিং রেট সাড়ে সাত ছাড়িয়ে গেছে। যুবরাজ বা কাইফ কেউই নেই। কে জেতাবেন? অনেকেই উঠে চলে গেলো টিভির সামনে থেকে। দ্রাবিড় আর বাঙ্গারের ওয়ান ডে খেলা কে দেখবে?

সেদিন ব্যাঙ্গারকে দ্রাবিড় কি বুঝিয়েছিলেন জানিনা, তিনি সম্ভবত জীবনের সেরা ওয়ান ডে ইনিংস খেলে যান, ৪১ বলে ৫৭ নট আউট, ৫ টা চার, ২ টো ছয়!! আর দ্রাবিড়, আবারো নিশ্চুপে তাঁর সেঞ্চুরি পুরো করেন। কোনো সেরকম বড়ো শট খেলেন নি, ১২৪ বলে ১০৯ নট আউট এর ইনিংসে মাত্র ৮ টা চার।

সারাক্ষণ খুচরো রান নিয়ে গেছেন আর পার্টনারকে বড়ো শট খেলার সুযোগ দিয়েছেন। ৩২৪ রানের বিশাল লক্ষ্য আড়াই ওভার বাকি থাকতেই সহজেই তাড়া করে ফেলে ভারত। ম্যান অফ দা ম্যাচ রাহুল হননি, হয়েছিলেন ক্রিস গেল, ঠিক যেমন হননি ইডেন টেস্টে, বা টনটনে, বা নিউজিল্যান্ডের সাথে হায়দ্রাবাদে নিজের সর্বোচ্চ ওয়ান ডে রান করার দিনেও। তিনি লিটল মাস্টার নন, চেস মাস্টার নন, মাস্টার ব্লাস্টার ও নন।

তিনি দ্য ওয়াল নামে পরিচিত, সেটাও টেস্ট ম্যাচের পরিপ্রেক্ষিতে। ওয়ান ডে তে কিন্তু তিনি খেলেছেন অনেক উপযোগী ইনিংস। ২২ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন, পাকিস্তানের মাঠে ম্যাচ ও সিরিজ জেতানো পারফরম্যান্স করেছেন, ইংল্যান্ডে ৬৩ বলে ৯১* করেছেন, আবার এই ম্যাচের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সোয়া তিনশো তাড়াও করেছেন অনাবশ্যক ঝুঁকি না নিয়ে। ৯০ এর নিচে স্ট্রাইক রেট নিয়েও সাড়ে ছয়ের আস্কিং রেট পার করেছেন অনায়াসে।

হ্যাঁ, হিরো হতে যাননি কখনো। ছয় মেরে সেঞ্চুরি, বাউন্ডারি মেরে ইনিংস শুরু, ছয় মেরে ইনিংস শেষ, খান বিশেক রান বাকি থাকতে লং অফের উপর দিয়ে ছয় বা স্কুপ মেরে চার মারার প্রচেষ্টা এসব তাঁর চরিত্রবিরোধী ছিল। তাই বরাবরই থেকে গেছেন প্রচারের আড়ালে। কখনো স্পটলাইট নিয়ে গেছেন শচীন, সৌরভ বা কখনো লক্ষণ, কিন্তু রাহুল থেকে গেছেন টিম ম্যান।

তাঁকে দিয়ে কিপিং করাতে ক্যাপ্টেনের কোনো অস্বস্তি হয়না, যেটা হয় অফ ফর্মের কাউকে ওপেনিং থেকে নিচে নামতে বলতে বা নিজের ব্যাটিং অর্ডার চেঞ্জ করতেও! অথচ মন্থর খেলার সমালোচনা করতে করতে আমরা প্রায় ভুলেই গেছি যে এই লোকটার ওয়ানডে তে প্রায় এগারো হাজার রান আছে, প্রায় চল্লিশের কাছে ব্যাটিং গড়!

ইংল্যান্ডের মত কঠিন পরিস্থিতিতে বিশ্বকাপে এই লোকটাই সর্বোচ্চ রান স্কোরার ছিল, হ্যাঁ সব দেশ মিলিয়ে। উল্টে বাঙালিদের কাছে তিনি পরিচিত হয়েছেন চক্রান্তকারী ভিলেন হিসেবে। ইডেনে তাঁকে শুনতে হয়েছে গো ব্যাক ধ্বনি।

এতো বড় তারকা হয়েও প্রত্যাখ্যান করেছেন সাম্মানিক পিএইচডি ডিগ্রি কেননা তাতে নাকি যাঁরা ডিগ্রীটা খেটে অর্জন করেন তাঁদের অসম্মান করা হয়, বা দাঁড়িয়েছেন ছেলের স্কুলের লাইনে আর পাঁচজন অভিভাবকের মতো কেননা কোনো অতিরিক্ত সুবিধা নেবেন না তিনি।

চিরকালের প্রচারবিমুখ, ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে – মা ফলেষু কদাচন:’ নীতিতে বিশ্বাসী ভদ্রলোকের আজ জন্মদিন। পঞ্চাশ বছরে পা দিলেন তিনি। নীরবে ভারতের পরবর্তী তারকাদের তুলে আনার কাজ করে চলেছেন তিনি নিরলসভাবে। রাহুল শরদ দ্রাবিড়, ওরফে জ্যামি! আপনার নামের আদ্যক্ষরের সাথে না মিললেও, আপনিও স্পেশাল, ভেরি ভেরি স্পেশাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link