টানা ৪৪ বছরের অপেক্ষা! ভাবা যায় সময়টা কত দীর্ঘ! কোন ব্যক্তির নয়, গোষ্ঠী বা দলের নয়, পুরো দেশের অপেক্ষা।
হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে সেই ৪৪ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছেন অ্যাশলে বার্টি। সর্বশেষ কোন নারী অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে এর আগে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছিলেন দানিয়েলে কলিন্স; ১৯৭৮ সালে। ফাইনালের জন্য অপেক্ষাটাও ৪২ বছরের।
কলিন্সের দুই বছর পর ওয়েন্ডি টার্নবুল সেই ১৯৮০ সালে উঠেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে। তিনি অবশ্য সেই ফাইনালে হেরে গিয়েছিলেন সরাসরি সেটেই সাবেক হয়ে যাওয়া এক দেশ চেকোস্লোভাকিয়ার হানা মান্দলিকোভার কাছে। তারপর থেকে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতা তো দূরে থাক, ফাইনালেও খেলতে পারেননি এই দেশটির কোনো নারী।
অবশেষে সেই স্মৃতি ফেরালেন এবার বার্টি। আজ ফাইনাল জিতে করলেন ইতিহাস।
আমার জন্য টেনিস খুব আবেগের একটা জায়গা।
টেনিস নিয়ে সবচেয়ে বড় স্মৃতি হয়ে জড়িয়ে আছেন আমার মা। একবার সপ্তাহের ছুটি কাটাতে টাঙ্গাইল বাসায় পৌঁছে দেখি আম্মা টেনিস খেলা দেখছেন। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলে আম্মা বলেছিলেন যে, ‘তোমাকে দেখি মন দিয়ে খেলাটা দেখো। তাই আমিও পেপারে পড়ে আর সুযোগ পেলে দেখে দেখে বুঝার চেষ্টা করি যে কিভাবে খেলাটা আগায়।’
আমি অবাক হয়ে দেখি আম্মা পয়েন্ট কিভাবে এগুচ্ছে তা বুঝছেন কিন্তু সার্ভের ফল্ট আর ডাবল ফল্টটা মেলাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছেন। এরপর একসাথে খুব অল্পই খেলা দেখেছি আমার অকালপ্রয়াত আম্মার সাথে। কিন্তু টেনিস আমার সাথে থেকে গেছে।
বার্টির গল্পটাতেও এমন আবেগের কিছু কথা আছে। কুইন্সল্যান্ডের একটা মধ্যবিত্ত এলাকা ইপসউইচে আদিবাসী পিতা আর অভিবাসী মায়ের ঘরে জন্ম তার। অস্ট্রেলিয়ান অন্যান্য পরিবারের মতোই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিলো তাদেরও। চার বছর বয়সে যখন বাসার গ্যারেজের দেয়ালে র্যাকেট দিয়ে বল পিটাতে দেখেন বার্টিকে তার বাবা, তখনই একদিন নিয়ে যান তাকে স্থানীয় টেনিস ক্লাবে।
আট বছরের আগে ভর্তি না নিতে চাইলেও সেই কোচ যখন বার্টিকে মজার ছলে বল ছুঁড়ে দেন আর তা যেভাবে ফেরাতে থাকে সে, তাতে করে পরের সপ্তাহেই ভর্তি হয়ে যেতে বলেন বার্টিকে! এটা মাত্রই ২০০০ সালের কথা। সেই থেকে ছোটবেলাতেই চোখে পড়ে যান স্কুলের কোচ আর টেনিস ঘরানার ব্যক্তিত্বদের। এর মাত্র ১৯ বছর পরে বার্টি জিতে নেন ফ্রেঞ্চ ওপেন আর গত বছরের উইম্বলডন!
এবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে বার্টি ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন অনেক হিসেবেই। শুধু অস্ট্রেলিয়ান হিসেবেই নন, বার্টি এখানকার তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা আদিবাসী গোত্রের একজন। এখনও তারকা হয়েও সেই মফস্বলেই বাস করেন বাবা-মায়ের কাছাকাছি থাকবেন বলে। তাই তার জয় শুধু একজন অজি হিসেবেই নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন যে জনগোষ্ঠী এই আদিবাসীরা, তাদের প্রতিনিধিত্বও করে।
খেলাধুলার যে শক্তি সবাইকে এক করার তা বলা নিস্প্রয়োজন। পৃথিবীর এক কোণে সেই কত আগে পেপারের খেলাধুলার পাতা আগ্রহ নিয়ে পড়তেন আমার মা, যাতে ছেলেদের সাথে বসে খেলা দেখতে পারেন বুঝে বুঝে! আজকে আমার মা বেঁচে থাকলে আমি নিশ্চয়ই তাঁকে ডেকে বলতাম যে দেখো এই মেয়েটাও কেমন করে উঠে এসেছে নিজের প্রতিভা আর পরিশ্রমের গুণে। সাথে ছিলো পুরাতন মনে হতে পারে সেই পারিবারিক মূল্যবোধও।
এই বার্টি ২০১৪তে জুনিয়র উইমেন উইম্বলডনের চ্যাম্পিয়ন হয়ে একটু একটু খ্যাতির ছোঁয়া পেয়ে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। নিজের ভুল বুঝে ডিপ্রেশনে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন টেনিস! নাম লিখিয়েছিলেন ক্রিকেটে, মেয়েদের বিগব্যাশে দলও পেয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে আমাদের বার্টি হয়েছেন টেনিসের নাম্বার ওয়ান।
অনেকদিন ধরে মেয়েদের টেনিসে ধারাবাহিক পার্ফর্মারের অভাব ঘুচে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে বার্টির মাঝে। তাই বার্টির অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের জয় শুধু অস্ট্রেলিয়ার জন্য নয়, পৃথিবীর সব কোণে যত টেনিসপ্রেমী দর্শক আছেন সবার জন্যই হতে পারে একটি দারুণ উৎসবের উপলক্ষ্য!
অবশেষে সেই বার্টি পার্টিতে মাতলো অস্ট্রেলিয়া।