ঢাকার মাটিতে প্রোটিয়া বীরত্ব

আইসিসি টুর্নামেন্ট ও দক্ষিণ আফ্রিকা-এই দুয়ের সাপে-নেউলে সম্পর্ক মোটামুটি সর্বজনবিদিত। কিন্তু অনেক অনেক দিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকার অধুনা কলঙ্কিত ও মৃত অধিনায়ক একটি আইসিসি ট্রফি নিয়ে পোজ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাও অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলক ও ল্যান্স ক্লুজনার ত্রয়ী বিহীন দল নিয়ে। ভারতের ক্রিকেট প্রেমীর কাছে বছরটা শচীন টেন্ডুলকারের বছর হিসেবেই বেশি পরিচিত।

ওই যে বছর শচীন শেন ওয়ার্নকে মেরে ছাতু করে দিয়েছিলেন। প্রথমে ভারতের মাটিতে টেস্ট সিরিজে, এবং তারপর শারজায়। এর বেশি বলা নির্ঘাত নিষ্প্রয়োজন। পাঠক নিশ্চয় বুঝে গেছেন কোন সালের কথা বলছি। ১৯৯৮। যাই হোক, সচিন বা তাঁর ব্যাটিং বিক্রম এই লেখার বিষয় নয়। কথা হচ্ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার আইসিসি ট্রফি জয় নিয়ে। ট্রফিটার অধুনা নাম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। সেবার ছিল প্রথম বার। নামটাও ছিল আলাদা। আইসিসি নকআউট ট্রফি। আদুরে নাম ছিল মিনি বিশ্বকাপ।

উইজডেনের সফরপঞ্জি বলছে, অ্যাসোসিয়েট দেশগুলোতে ক্রিকেটের প্রসার ঘটাতেই এই ট্রফির জন্ম। বা বলা ভালো, অ্যাসোসিয়েট দেশগুলোতে ক্রিকেটের প্রসার ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহই ছিল এই টুর্নামেন্টের মূল উদ্দেশ্য। কাজেই কোনো প্রতিষ্ঠিত টেস্ট খেলিয়ে দেশে সেই টুর্নামেন্ট না করে, আইসিসি প্রতিযোগিতাকে নিয়ে গিয়ে ফেলে বাংলাদেশে।

তার আগে অবশ্য ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ড ও শারজায় করানোর কথাও ভাবা হয়। সে বছর বাংলাদেশে বিরাট বন্যা হয়। সেরকম বন্যা বাংলাদেশে আগে কমই হয়েছে। রিলিফ ওয়েবের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় তিন কোটি লোক সেই বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হয়ে যাওয়া সেই বন্যায় , ঢাকা প্রায় টুর্নামেন্ট করানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছিলো।

ঢাকার অনতিদূরে অনেক ভালো ক্রিকেট পরিকাঠামো সমৃদ্ধ কলকাতায় টুর্নামেন্ট নিয়ে গিয়ে ফেলার আলোচনাও হয়। কিন্তু শেষমেশ ঢাকাই বরাত পায়। এবং পেয়ে একেবারেই হতাশ করেনি। সব ম্যাচেই মাঠ ছিল কানায় কানায় ভরা। বাংলাদেশ সেই টুর্নামেন্টে না থেকেও ছিল। তাদের সমর্থকরা ছিলেন যে। এবং বেশির ভাগ দল তাদের সেরা এগারো মাঠে না নামানো সত্ত্বেও। এটা শুধু ক্রিকেট প্রেম নয়। রীতিমতো ক্রিকেট আসক্তি।

টুর্নামেন্ট শুরুই হয় নিউজিল্যান্ড জিম্বাবুয়ের মারকাটারি প্রাক-কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ দিয়ে। জিম্বাবুয়ের ২৫৮ রান নিউজিল্যান্ড একেবারে শেষ বলে এসে টপকায়। প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ইংল্যান্ডের সেবার অ্যাশেজ সফর ছিল। কাজেই ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) এই আপাত গুরুত্বহীন টুর্নামেন্টে একেবারে দ্বিতীয় সারির দল পাঠায়।

গ্রায়েম হিক, অ্যাডাম হোলিওক বা জ্যাক রাসেল বাদে চেনা মুখ প্রায় নেই। বছর খানেক আগেই এই হোলিওকের নেতৃত্বেই একই রকম অচেনা দল নিয়ে, অ-ইংরেজিয় ক্রিকেট খেলে, শারজায় চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্ট জিতে ইংল্যান্ড তাক লাগিয়ে দেয়। এবারেও আগে ব্যাট করে, তৎকালীন বিচারে একটি অ-ইংরেজিয় স্কোর তারা করে ফেলে, ২৮১। সেই সময় ২৮১ মোটামুটি নিরাপদ স্কোর। কিন্তু উলমারের দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য নয়।

হ্যান্সি ক্রনিয়ের দক্ষিণ আফ্রিকা না বলে উলমারের দক্ষিণ আফ্রিকা বললাম কারণ দলটার চালিকা শক্তি ওই সাদা চুলের ল্যাপটপ হাতে লোকটিই ছিলেন। ইএসপিএন ক্রিকনফোতে একটি লেখায় পড়ছিলাম উলামার সেই দলে ফিটনেস ও স্ট্রেন্থ কোচ নিয়ে আসেন। তৎকালীন ক্রিকেটে যা অভাবনীয়। অভাবনীয় এজন্যই, যে বাকি দলগুলো তখনও এসব ভাবেইনি। এমনকি অস্ট্রেলিয়াও নয়।

ভারতের ফিটনেসের দায়িত্বে তখন যিনি ছিলেন, তিনি তাঁর ডাক্তারি বা ফিজিওগিরির চেয়েও বেশি পরিচিত ছিলেন তাঁর টাক মাথা ও কূটকচালি করার জন্যে। আলী ইরানি। এছাড়াও ক্রনিয়ে কে মাঠে চিট পাঠানো, ব্যাটার ধরে ধরে আলাদা আলাদা পরিকল্পনা, ক্রিকেটে এগুলো উলমারের আমদানি। দলটিতে বিশেষ কোনো তারকা না থেকেও তাই তারা মেশিনের মতো ক্রিকেট খেলতে পারতো।

ভারত এই টুর্নামেন্টে সেমিফাইনাল অবধি পৌঁছায়। কোয়ার্টার ফাইনালে শচীনের ১৪১ অস্ট্রেলিয়াকে বাড়ি পাঠায়। আর সেমি ফাইনালে সৌরভের ৮২ সত্ত্বেও ওয়ালেস ও শিবনারায়ন চন্দরপলের বিক্রম ভারতকে বাড়ি পাঠায়। ঢাকার দর্শক অবশ্য তাতেই খুশি। পরপর দুই ম্যাচে তাঁরা শচীন ও সৌরভের বড়ো রান দেখেছে। বাংলাদেশে তখন যেকোনো স্থানীয় ক্রিকেটারের চেয়ে শচীন বা সৌরভ অনেক বেশি জনপ্রিয়। ভারতে এখন যেমন ছেত্রির চেয়ে বেশি মেসি বা রোনালদো জনপ্রিয়।

ফিলো ওয়ালেস ছিলেন এই টুর্নামেন্টের আবিষ্কার। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৫৮ বলে ৭৯ এবং ভারতের বিরুদ্ধে ৪৫ বলে ৩৯ করেন। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। যে ভঙ্গিতে করেন, সেটাই নজর কাড়ার মতো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় শট নেবার ক্ষমতা তাঁর আগে বা পরে বহু ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারের ছিল। কিন্তু ওয়ালেস সেটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান।

সেই টুর্নামেন্টে তিনি যেন গেলের আগের গেল। ফাইনালে তিনি করেন ১০২ বলে ১০৩। ইনিংসে ছিল ১১টি ৪ ও ৫টি ছক্কা। অর্থাৎ ১৬ বলে ৭৪। বাকি ৮৬ বলে মাত্র ২৮। খানিকটা হয় মারবো নয় ডট খাবো জাতীয় ব্যাপার। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাইনালে ২৪৫ এর বেশি করতে পারেনি। ক্রনিয়ের ৬১, ক্যালিসের ৩৭ ও রিনডেলের ৪৯ দক্ষিণ আফ্রিকাকে অভিষ্ঠ লক্ষে আরামসে পৌঁছে দেয়।

দক্ষিণ আফ্রিকাকে এরপর ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থার মার্কামারা কোনো ট্রফি জিততে ১৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়। তবে সেটি বড়দের কাপ না। অনূর্ধ্ব ১৯ এর বিশ্বকাপ। বড়দের ট্রফি পাবার অপেক্ষা এখনও চলছে।

ভাবতে আশ্চর্য্য লাগে, ঠিক মাস আষ্টেক বাদেই উলমারের মতো হিসেবি কোচের হিসেবি দলের দুই সদস্য কিভাবে ওই একটি রান নিতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেললেন। সেই গুলিয়ে ফেলার সুনামির কাঁপুনি এখনও মাঝে মধ্যে অনুভূত হয়। আর ক্রন্দনরত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারের ছবি ভাইরাল হয় বছর বছর। এবি ডি ভিলিয়ার্স, ডেল স্টেইন, গ্রায়েম স্মিথ, ফাফ ডু প্লেসিস-এতোদিনেও কেউ সেই কাঁপুনির এন্টিডোট খুঁজে পাননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link