ক্রিকেটও ছিল তাঁর সুরে

‘লাগ যা গালে কে ফির ইয়ে হাসিন রাত হো না হো, শায়েদ ফির ইস জানাম মে মোলাকাত হো না হো…

গানের দ্বিতীয় লাইনটা সত্যি হয়ে গেলো। আর ‘মোলাকাত’ হবে না ভারতের কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী, সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের সাথে। তিনি পাড়ি জমালেন দূর দেশে। কেবল সুরের রানী নন, এ এক ক্রিকেট ভক্তেরও প্রয়ান। হ্যাঁ, প্রয়াত লতা মঙ্গেশকর ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের একনিষ্ঠ একজন সমর্থক।

এই গল্পটা হয়ত অনেকের অজানা কিংবা জানা। তবে লতা মঙ্গেশকর বহুকাল ধরেই ভারতীয় ক্রিকেটের নিয়মিত এক দর্শক। ক্রিকেট এবং সংগীত দু’টি ভিন্ন এক পেশা কিংবা শিল্প। এই ভিন্ন দুই পেশার মানুষের এক সাথে কাজ করবার সুযোগ সচারচর আসে না। তবুও সাধারণ একজন সমর্থক হওয়ার পাশপাশি লতা মঙ্গেশকর বহু ক্রিকেটারদের সাথে সুস্পর্ক বজায় রেখেছিলেন নিজের জীবনের শেষ দিন অবধি। সেই তালিকায় রয়েছেন কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারও।

প্রায় তিন দশক আগে মুক্তি পাওয়া গান, ‘মিলে সুর মেরা তুমাহারা’ গানের মিউজিক ভিডিওর সুবাদে প্রথম ক্রিকেটারদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন লতা জি। সেই মিউজিকে ভারতের নামকরা বহু ক্রিকেটার ছিলেন। শ্রীনিবাসরাঘবন ভেঙ্কেটরাঘবন, প্রকাশ পাডুকন, নরেন্দ্র হিরওয়ানি, অরুণ লালদের মতো তারকা ক্রিকেটারদের সাথে পরবর্তী সময়েও হৃদ্যতা ছিল তাঁর।

এছাড়াও তিনি সামনে থেকে দেখেছিলেন ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের মহাকাব্য। এ বিষয়ে তিনি পরবর্তী সময়ে বলেছেন, ‘আমি ফাইনাল ম্যাচটি লর্ডসে বসে দেখেছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমরা দুই বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে শিরোপা জিতে নিয়েছি। একজন ভারতীয় হিসেবে আমার সেদিন খুব গর্ব হচ্ছিলো।’

সেই বিশ্বকাপ জয়ীদের সম্মানে সেই বছর বিনা পারিশ্রমিকে একটি কনসার্টও করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর।

১৯৮৩ সালের সেই বিশ্বকাপ জেতার পর ভারত ক্রিকেট দল একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছিলো। যেখানে লতা মঙ্গেশকরকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন কপিল দেব। লতা জি সেই স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছিলেন, ‘শিরোপা জেতার পর কপিল দেব আমাকে লন্ডনে হওয়া দলীয় নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি সেখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় পার করেছিলাম। খেলোয়াড়দেরকে এমন ঐতিহাসিক এক বিজয়ের জন্যে অভিবাদন জানিয়েছিলাম।’

এতেই খানিকটা আন্দাজ করে নেওয়া যায় ভারতীয় ক্রিকেটের ঠিক কতটা কাছাকাছি ছিলেন তিনি। এর থেকে বড় উদাহরণ হতে পারে তাঁর এবং শচীন টেন্ডুলকারের মধ্যকার হৃদ্যতা। মা-ছেলের এক অপূর্ব সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো তাঁদের মাঝে, ‘শচীন আমাকে সবসময় নিজের মায়ের মতোই সম্মান করে। আমি সেদিনটা কোনদিনই ভুলতে পারবো না যেদিন সে প্রথমবার আমাকে আই(মা) বলে ডেকেছিলো। সেটা এক অকল্পনীয় এবং অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ছিলো আমার জন্যে।’

তাছাড়া শচীন তাঁর বায়োপিক ‘শচীন: আ বিলিয়ন ড্রিমস’ এর প্রচারণা ও কাজে ব্যস্ত তখন সেই সিনেমার সাফল্য কামনা করে লতা মঙ্গেশকরের দেওয়া একটি টুইটা বার্তার জবাবে শচীন লিখেছিলেন, ‘মায়ের আশির্বাদ ছাড়া চার-ছক্কা মারা যায় না। আপনি আমার কাছে মায়ের মতো। আপনার আশির্বাদের জন্যে ধন্যবাদ।’

এই দুইজনের এমন গভীর হৃদ্যতার পেছনে অবশ্য ভিন্ন এক গল্প রয়েছে। শচীন টেন্ডুলকারকে ভারত রত্ন পুরষ্কারে ভূষিত করা নিয়ে রীতিমতো এক অলিখিত আন্দোলন করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। ২০১০ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মতে সে সত্যিকার অর্থেই ভারত রত্ন। সে এখন পর্যন্ত দেশের জন্যে যা করেছে তা আর কেউ করেনি। সে আমাদেরকে গর্বিত করেছে বারংবার।’ এমন সব বক্তব্য গণমাধ্যমেই খোলামেলা ভাবেই দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।

শুধু তাই নয় বিরাট কোহলি যখন ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৩৫ রানে এক দূর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন টেস্টে তখন তাঁকেও অভিবাদন জানিয়ে টুইটারে পোষ্ট করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। অভিবাদন ছাড়াও নিজের গাওয়া গান ‘আকাশকে উসপার ভি’ গানটি উৎসর্গ করেছিলেন। সেই সাথে তাঁর ভিভিএস লক্ষণের মতো খেলোয়াড়দেরও প্রশংসা করেছেন তিনি।

তাঁর বিদায়ে ভারত শুধু একজন সুরের সাধনাকারীকে নয়। হারিয়েছে ক্রিকেটের এক একনিষ্ঠ সমর্থককে। তবুও একজন লতা মঙ্গেশকর তাঁর সুরের মূর্ছনায় চিরকাল অমর হয়ে রইবেন আপামর জনতার মাঝে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link