ওয়াংখেড়েতে আজাজ প্যাটেলের সামনে তখন হাতছানি এক ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়ার। আজাজের চেহারায় যেন এক অন্যরকম উত্তেজনার ছাপ। আরেকপ্রান্তে বোলিং করছিলেন রাচিন রবীন্দ্র। হয়তো কিছুটা নার্ভাসও ছিলেন আজাজ!
আর একটি উইকেট পেলেই যে গড়বেন অনন্য এক রেকর্ড! সেটি যদি রাচিনের ভাগ্যে থাকে তাহলে অল্পের জন্য এই রেকর্ডে নাম লেখাতে পারবেন না তিনি। ঠিক এই মূহুর্তগুলো তখন ক্যামেরার চোখে চোখ রেখে দেখছিলেন ওই ম্যাচের এক ক্যামেরা ক্রু তাকি রাজা। শুধু নিজেই নয় ক্যামেরার চোখ দিয়ে লাখ লাখ দর্শককে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো দেখাচ্ছিলেন তিনি।
এরপরই দশ উইকেট শিকারের অনন্য রেকর্ড গড়লেন আজাজ প্যাটেল। অজান্তেই যেন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন রাজা। কারণ তিনি একমাত্র ক্যামেরা পার্সন যিনি এক ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়া তিন কীর্তির দু’টির সাক্ষী ছিলেন ক্যামেরার পেছন থেকে। আজাজের আগে ১৯৯৯ সালে অনিল কুম্বলের শিকার করা ইনিংসে দশ উইকেটের দিনেও ক্যামেরা ক্রু হিসেবে কাজ করছিলেন তাকি!
- ৭, ৮, ৯ – গণনা
ঐতিহাসিক সেই রেকর্ডের আগে রাজা নিজের মনে মনেই ৭, ৮, ৯ এভাবে গণনা শুরু করেছিলেন। রাজা বলেন, ‘যখন ৮ উইকেট গেল তখন আমি নিজেকে নিজেই বললাম আমি কি আরো একবার এই অনন্য রেকর্ডের সাক্ষী হতে পারবো? আমি একমাত্র ক্যামেরা পার্সন ছিলাম যে আগের রেকর্ডের সাক্ষী ছিলাম। ক্যামেরাম্যান হিসেবে সবার সাথে কথা বলার স্বাধীনতা তো আমাদের নেই। আমাদের কাজ তো ক্যামেরার চোখে মনযোগী হওয়া। যখন আজাজ দশ উইকেট ছিল আমি নিজে নিজেই অনেক আনন্দিত ছিলাম।’
২২ বছর আগেও অবশ্য রাজা সাক্ষী হয়েছিলেন এমন রেকর্ডের। দিল্লিতে রাজনৈতিক পার্টি শিব সেনারা তখন হুমকি দিয়েছিল পাকিস্তানকে দিল্লীতে ঢুকতে দিবে না বলে। যার কারণে পুরো স্টেডিয়ামের গেইট লক করে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। রাজার ভাষ্যমতে, ‘সবার মধ্যে ভয় ছিল প্রতিবাদীরা স্টেডিয়ামে সাপ পাঠাতে পারে। তাই কর্তৃপক্ষ বাউন্ডারি লাইনের পাশে সাপ ধরার লোকও রেখেছিল! যাতে সাপ ঢুকে পড়লেও তাঁরা সেটি ধরতে পারে।’
তবে দিনশেষে সেবার অনিল কুম্বলের বিষেই নীল হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের ব্যাটাররা। আজাজের রেকর্ডটি ধারণ করা ছিল ৩৫টি ক্যামেরায়, অপরদিকে কুম্বলের সময় ছিল মাত্র আটটি ক্যামেরা।
ক্যামেরা ক্রু হিসেবে কাজ শুরুর পর থেকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী হন রাজা। ভারতের ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের সময়ও ছিলেন ক্যামেরার পেছনে। প্রো কাবাডি থেকে ফর্মুলা-১ রেস ক্যারিয়ারে সবকিছুতেই ক্যামেরার পেছনে কাজ করেছেন তিনি।
১৯৯৯ সালে আজকের মতো আল্ট্রা এজ, রিভিউ সিস্টেম বা এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ছিল না। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই ছিল সবশেষ। রাজা বলেন, ‘আমার জন্য কুম্বলের পারফরম্যান্স সব সময়ই একটু উপরে থাকবে। কারণ এটা পাকিস্তানের বিপক্ষে তাও ঘরের মাটিতে যেখানে কুম্বলে অনেক চাপে ছিল। এবং সে একাই দলকে জিতিয়েছে। আজাজকে পেছনে ফেলছিনা তবে আমার জন্য কুম্বলের পারফরম্যান্সটা সেরা।’
- কঠিন কাজ
ক্যামেরার পেছনের কাজটা সব সময়ই কঠিন। ম্যাচের আগে সবকিছু পরীক্ষা করা, ম্যাচের দিনের ক্লান্তি। বৃষ্টি হোক কিংবা খেলা পরিত্যাক্ত আমাদেরকে ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের একটি মূহুর্ত স্মরণ করে রাজা বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে কোহলিকে দেখছিলাম বার বার মাঠের বাঁ-দিকে তাকাচ্ছিলো। আমি ভাবছিলাম পরিবারের কেউ এলো কিনা। কিন্তু হঠাৎ বিরতির সময় দর্শক স্ট্যান্ডের দিকে দৌড়ে গিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে করে বললেন স্টিভ স্মিথকে দুয়ো দিও না।’ স্যান্ডপেপার কাণ্ডে নিষেধাজ্ঞার পর তখন স্মিথ ওই বিশ্বকাপে ফিরেছিল। ‘আমি একমাত্র ক্যামেরা পার্সন যে ওই শটটা নিয়েছিলাম!’
রাজা আরো বলেন, ‘এটা এক প্রকার একাকিত্বের মতোই। ক্যামেরাম্যানরা চাইলেই তাঁদের জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারে না। সাবেক ওপেনার বীরেন্দ্র শেবাগ মাঝে মাঝে আমাদের এদিকে আসতো মুলতান স্টেডিয়ামে খেলতে গেলে। কারণ আমাদের এরিয়াটা ড্রেসিং রুমের পাশেই ছিল। সে আসতো কথা বলতো।’ রাজা আরো বলেন, ‘ ক্যামেরাম্যানদের স্বাধীনতা নেই, প্রযোজকরা যা বলে সেটাই করতে হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা যেকোনো আবহাওয়াতেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ‘
১৯৫৬ সালে জিম লেকার, ১৯৯৯ সালে অনিল কুম্বলে এবং ২০২১ সালে আজাজ প্যাটেল! এই তিন ঐতিহাসিক রেকর্ডের মাঝে দু’টির সাক্ষী হওয়া একমাত্র ক্যামেরা ক্রু হলেন – তাকি রাজা।