চারদিকে সমুদ্র তরঙ্গের মাঝে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটি।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তখন যুদ্ধের তৎপরতা। বাইরের গেটে প্রহরীরা হিমশিম খাচ্ছেন লোকেদের সামলাতে। ভেতর থেকে বাড়তি পুলিশ ডাকতে হয়েছে। লোকেরা স্রোতের মতো আসছেন মিছিল নিয়ে; হাতে ব্যানার, ফেস্টুন আর ছোটো ছোটো বাঘ।
ভেতরেও পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধের না। শত শত সাংবাদিক আর চিত্রগ্রাহককে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে লাইন ধরে ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু তাদের এক জায়গায় আটকে রাখা যাচ্ছে না। তারা চাচ্ছেন যাত্রীদের আসার পথের আরো যত কাছে যাওয়া যায়। এ নিয়ে হুড়াহুড়ি, চিৎকার আর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।
এর মধ্যেই চকচকে চোখে, আটপৌরে পোশাকে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটি। কাছে গিয়ে পরিচয় দিতে নিজে থেকেই বলল, ‘বন্ধুদের নিতে এসেছি।’
ছেলেটির নাম মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী। বিশ্বকাপ দলে ছিলেন; অপরিহার্য সদস্য ছিলেন। কিন্তু ইনজুরি তাকে আগেভাগে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এমন দিনে শরীরের ব্যথা তাকে বাসায় আটকে রাখতে পারেনি। সব অগ্রাহ্য করে চলে এসেছেন বিমানবন্দরে। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ী দলে থাকতে না পারা, ওদের সঙ্গে উল্লাস করতে না পারার কষ্ট আছে না?
প্রশ্নটা শুনে মৃত্যুঞ্জয় হাসলেন, ‘কষ্ট আছে। কিন্তু আজ নিজেকে খেলোয়াড় মনে হচ্ছে না। দেশের সাধারণ একজন মানুষ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের বরণ করে নিতে এসেছি। এটাই সৌভাগ্য মনে হচ্ছে।’
এটুকু সৌভাগ্যতেই অবশ্য আটকে থাকার কথা ছিলো না মৃত্যুঞ্জয়ের। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ২০২০ সালের যুব বিশ্বকাপ অভিযাত্রী দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ইঞ্জুরি তাকে টুর্নামেন্টটা শেষ করতে দেয়নি। তবে ইতিমধ্যে মৃত্যুঞ্জয় নিজেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সম্পদ বলে প্রমাণ করতে শুরু করতে পেরেছেন।
অনেকদিন পর চলতি বিপিএলে ফিরলেন ইনজুরি থেকে পুরো সেরে উঠে। প্রথম দিকে ম্যাচ খেলতে পারেননি। আজ সবমিলিয়ে নিজের পঞ্চম ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন। তাতেই তার ঝুলিতে ১০ উইকেট। উইকেট সংখ্যাও অবশ্য এই টুর্নামেন্টে মৃত্যুঞ্জয়ের ইমপ্যাক্ট বোঝাতে পারছে না।
টুর্নামেন্ট জুড়ে বল করেছেন মূলত ডেথ ওভারে। বেশিরভাগ দিনই অত্যন্ত কৃপণ বোলিং করে দলকে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। আজ যেমন শেষ ওভারে ৯ রান দরকার ছিলো প্রতিপক্ষের। উইকেটে তামিমের মত ব্যাটসম্যানকেও বন্দী রেখে ম্যাচ জিতিয়েছেন চট্টগ্রামকে।
আশা তৈরি করেছেন, মৃত্যুঞ্জয় এই যাত্রাটা সর্বোচ্চ স্তরেও ধরে রাখবেন।
ক্রিকেটের এই যাত্রায় মৃত্যুঞ্জয়ের প্রধান অবলম্বন তার বাবা। মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা তাহাজ্জত হোসেন চৌধুরী ক্রিকেটের পাঁড়ভক্ত। না হলে কি আর কোনও বাঙালি বাবা সন্তান জন্মের পরই তাকে পেস বোলার বানানোর স্বপ্ন দেখেন! সেই স্বপ্নপূরণের পথে বড় বাধা ছিলো শহর থেকে দূরে সাতক্ষীরার সাদামাটা জীবন।
সেখানে ছিল না ক্রিকেটের কোনও অবকাঠামো। ২০০০ সালে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার হিজলদী গ্রামে জন্ম মৃত্যুঞ্জয়ের। শৈশব ওখানে কাটলেও ২০১০ সালে সাতক্ষীরা থেকে মৃত্যুঞ্জয়দের পরিবার চলে আসে ঢাকায়। খুলে যায় তার পেসার হওয়ার স্বপ্নপূরণের দুয়ারও।
নিজে ওয়াসিম আকরামের বোলিংয়ের ভক্ত বলে ছেলেকেও ‘সুলতান অব সুইং’-এর মতো দেখার স্বপ্ন ছিলো তাহাজ্জত হোসেনের । সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ২০১২ সালে ক্রিকেট কোচিং স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করে দেন।
আবাহনী মাঠ থেকে শুরু হয় মৃত্যুঞ্জয়ের স্বপ্নপূরণের লড়াই। পেস বোলিংটা তাঁর সহজাত দ্রুতই বয়সভিত্তিক দলের সিঁড়ি ভেঙে বাংলাদেশ যুবদলে জায়গা করে নেন। সেই তাঁর হাতেই এখন আইসিসি অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করার চ্যালেঞ্জ।
পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংটাও করতে পারেন। দলের অন্য পেসারদের মধ্যে তার ব্যাটিংই সবচেয়ে ভালো। ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস তার পছন্দের ক্রিকেটার। তবে মৃত্যুঞ্জয়ের স্বপ্নের ক্রিকেটার প্রোটিয়া পেসার ডেইল স্টেইন। হতে চান তার মতোই। অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অন্য ক্রিকেটারদের মতো তারও মনজুড়ে জাতীয় দলে খেলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
২০১৮ সালে আফগানিস্তান অনূর্ধ্ব ১৭ দলের বিপক্ষে সিরিজ খেলতে ভারত সফরে যান মৃত্যুঞ্জয়। সেই সিরিজে দারুণ সব কাটার ও রিভার্স সুইংয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের নাকাল করে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন সাতক্ষীরার তরুণ। এরপর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় অনূর্ধ্ব ১৯ ত্রিদেশীয় সিরিজেও দারুণ পারফর্ম করেন।
যুব ওয়ানডের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয়। স্বপ্ন ছিলো এই সংখ্যাটা আরও বড় করবেন। কিন্তু সেটা করার আগেই চোটের কারণে দেশে ফিরে আসতে হয়। তাই বলে স্বপ্নটা শেষ হয়নি মৃত্যুঞ্জয়ের।