তখন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে স্বর্ণযুগ চলছে। ক্রিকেট মাঠে সৌরভ ছড়াচ্ছেন একদল অপরাজেয় যোদ্ধা। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মার্ক ওয়াহর যোগ্য উত্তরসূরি এবং মহান অ্যাডাম গিলক্রিস্টের যোগ্য ‘ওপেনিং পার্টনার’ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায় অস্ট্রেলিয়া দল।
এই সময় এল সেই বিখ্যাত ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজ। মুম্বাইয়ে টেস্ট জিতে সেই অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া দল টানা টেস্ট ম্যাচ জয়ের সংখ্যাটিকে ১৬ তে নিয়ে গিয়েছে তখন আমাদের গর্বের ইডেনে খাদের কিনারা থেকে দলকে তুলে আনলেন বহু যুদ্ধের পোড় খাওয়া দুই যোদ্ধা দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ জুটি। তাতে ‘মাইডাস টাচ’ দিলেন টার্বুনেটর খ্যাত ভাজ্জি যার রেশ চলেছিল পরবর্তীতে চেন্নাইতেও।
এক ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয় পেয়েছিল এক হাল না ছাড়া অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। এই সিরিজে পরাজয় ঘটলেও অস্ট্রেলিয়া দল পেয়ে গেল এক অসাধারণ ওপেনারের, যিনি প্রায় এক অর্ধদশক আগে দেশের সম্মানজনক ‘ব্যাগি গ্রিন মাথায় নেওয়ার সুযোগ পেলেও এই ঐতিহাসিক সিরিজে একটি ডাবল সেঞ্চুরি, দুটি সেঞ্চুরি ও দুটি হাফ সেঞ্চুরি সহ ছয়টি ইনিংসে ১০০ এর বেশি গড় সহ ৫৪৯ রান করে নিজেকে প্রমাণ এবং দলের একজন ‘ভবিষ্যৎ স্থপতি’র অন্যতম দাবীদার হিসেবে তুলে আনলেন। এর প্রভাব বা নিদর্শন পরবর্তী দুটো বিশ্বকাপেই দেখা গিয়েছিল।
তিনি হলেন ম্যাথু হেইডেন। বিশ্ব ক্রিকেটে এই নামের ‘ইমপ্যাক্ট’ কতটা সুদূরপ্রসারী তা ক্রিকেট নিয়ে যারা খবর রাখে তাদের নতুন করে বলে দিতে হয় না। তবে সাফল্য সহজে আসেনি। আমরা যদি তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের দিকে তাকাই তাহলে তার ক্যারিয়ারে দুটো অংশে ভাগ করা যাবে – ২০০১ এর আগে ও ২০০১ এর পরে। প্রথম অংশে সাত বছরে বলবার তেমন কিছুই নেই, মাত্র ১৩ টি টেস্ট ও পরের অংশে ৯০ টি টেস্ট, যাতে গড়ও অসাধারণ ও অন্যদিকে রেকর্ডের ফুলঝুরি ঘটিয়েছেন।
২০০৩ বিশ্বকাপের আগে যিনি ১০ বছরে মাত্র ৫৪ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিলেন, সেই তিনি ২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপ মিলিয়ে প্রায় ১০০০ এর কাছাকাছি রান করেছেন, ২০০৭ বিশ্বকাপে তো ৬৫০-এর বেশি রান করে ওই প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন। দুটি বিশ্বকাপের ফাইনালেই তার সহযোগী গিলক্রিস্ট বোলারদের তুলোধোনা করেছিলেন কিন্তু উল্টো দিকে তিনি নিজের খেলাটা খেলে একজন অকীর্তিত নায়ক হিসেবে তুলে ধরেছেন।
দুটি ইনিংসে তাঁর ভারতের বিরুদ্ধে ৫৪ বলে ৩৭ কিংবা শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৫৫ বলে ৩৮ হয়তো অন্যদের তুলনায় ফিকে লাগতে পারে। কিন্তু ওই দুটো ইনিংস বিশ্বকাপ জয়ের প্রাথমিক ভিত গড়ে তোলার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।
বিশ্ব ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অস্ট্রেলিয়ার দুই ধরনের ফরম্যাটে দুই কিংবদন্তি ওপেনার জাস্টিন ল্যাঙ্গার ও গিলক্রিস্টের এর সাথে হেইডেনের মাঠের বাইরে সম্পর্ক ও মাঠের ভিতরে বড় বড় সব জুটি আধুনিক ক্রিকেটকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে ল্যাঙ্গারের সাথে ইনিংস প্রতি ৫০-এর বেশি গড়ে ১৪ টি সেঞ্চুরি সহ ৬০০০-এর বেশি রান যোগ করেছেন যা বিশ্বে চতুর্থ।
অন্যদিকে গীলখ্রীষ্টের সাথে ৫০ এর কাছাকাছি গড়ে ১৬ টি সেঞ্চুরি সহ ৫৫০০ এর কাছাকাছি রান করেছেন। এই দুই জুটি কত বোলার ও অধিনায়কের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি দিনের পর দিন। ক্রিকেট ইতিহাসে এই দুই জুটির কাহিনী একটি দলের বিশ্ব ক্রিকেটে পরাক্রমতার, কতৃত্বতা ও সাফল্যের গল্প বহু শতাব্দী পরেও বলবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
২০০৩ সালের অক্টোবরে তিনি পার্থে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে ৩৮০ রানের ইনিংস খেলেন। সেটাই তখন টেস্টের ইতিহাসের সেরা ইনিংস ছিল, হেইডেন ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং ব্রায়ান লারাকে। যদিও, শীর্ষে হেইডেন থাকতে পেরেছিলেন মাত্র মাস ছয়েক। আবারও শীর্ষে ফেরেন লারাই, ৪০০ রানের ইনিংস খেলে। লারার রেকর্ডটা এখনও টিকে আছে।
হেইডেনের ক্যারিয়ারের একদম শেষ ভাগে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের আবির্ভাব ঘটে। তবে, তাতেও তিনি ছিলেন হট কেক। তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রথম তিন আসর খেলেন চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে। ২০০৯ সালে জেতেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের অরেঞ্জ ক্যাপ, ২০১০ সালে জিতেন শিরোপা। ২০১০ সালে আইপিএলে তিনি ‘মঙ্গুজ’ নামের ভিন্নরকম এক ব্যাট নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, যা ছিল ওই সময়ের টক অব দ্য টাউন।
পৃথিবীতে কিছু ক্রিকেটার থাকেন যারা নিজেদের মাঠে তাদের অস্তিত্ব দিয়ে নিজেদের চিনিয়ে দেন, যতটা না তাদের নৈপুণ্যতা বা দক্ষতা দিয়ে। আমাদের শৈশবের অন্যতম প্রিয় হেডোস সেই ধরনের ক্রিকেটার বা মানুষ। তবে তার মানে এই নয় যে তার দক্ষতা, নৈপুণ্যতা কিংবা দৃঢ়তা ছিল না, কিন্তু এসবের সাথে বিপক্ষ বোলারদের যে তিনি প্রথম বল থেকেই ‘মাথায় চড়ে বসতে’ চাইতেন সেটাই বোলারদের ভীতির কারণ হয়ে উঠেছে বারবার।
টেস্ট ক্রিকেটে অসাধারণ সাফল্য এবং অর্জনের পরও ৯০-এর দশকের সেই সব অল্প কিছু ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনিও অন্যতম যিনি ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণকেও নিজের পরাভূত করতে পেরেছিলেন নিজের অসাধারণ দক্ষতায়।
তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত ‘ম্যাচ উইনার’ যিনি নিজের সীমিত সামর্থ্যকে জয় করে অস্ট্রেলিয়ার সেই স্বর্ণযুগের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজেকে তৈরী করতে পেরেছিলেন, যা সত্যিই অনন্য কৃতিত্বের। আমরা যখনই বর্তমানে তার কথা ভাবি বা আলোচনা করি তখনই ‘বোলারের দিকে তেড়ে আসছেন ওই দীর্ঘদেহ নিয়ে কোনো রকম ভীতি ছাড়াই’ – এমন একটা চিত্র বারবার ফুটে ওঠে যা সততই মধুর।
ভিন্নধর্মী একটা তথ্য দিয়ে শেষ করি। ম্যাথু হেইডেন কেবল বাইশ গজেই নয়, রান্নাঘরেও দারুণ। তিনি নিজে ভোজন রসিক ও তাঁর রান্নার হাতও নাকি দারুণ। এমনকি তিনি খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করার আগেই দু’টো রান্নার বই লিখেছেন!