একগুঁয়ে ফেওলা ও একজন পেলে

ফাইনালে ব্রাজিলের পঞ্চম ও পেলের দ্বিতীয় গোলের পর মাঠেই কাঁদতে থাকেন পেলে। সাও পাওলোর রাস্তা থেকে স্টকহোমের রঙিন পৃথিবীতে তাকে টেনে এনেছিল তাঁর গগনচুম্বী প্রতিভা আর ফেওলার নি:স্বার্থ বিশ্বাস। ফাইনালের পর সুইডেনের ডিফেন্ডার সিজ্জে পার্লিং বলেছিলেন- ‘আমি খুব ভাগ্যবান এমন ক্ষণজন্মা প্রতিভার বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পেয়েছি...’

ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতা না হলে এতটা ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা পেতে হত না গুস্তাভ সেবেচকে। চুয়ান্নর বিশ্বকাপের পর আটান্নর বিশ্বকাপেই ভেঙে গেল হাঙ্গেরির ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স। সেবেচের স্বপ্নের দল। সোভিয়েতের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ফেরেঙ্ক পুসকাস, জিবররা পাকাপাকি চলে গেলেন স্পেনে।

চুয়ান্নতে পশ্চিম জার্মানি জিতলেও তাই আটান্নর বিশ্বকাপের আগে একটা দলকেও ফেবারিট বলা গেল না। কিন্তু ইউরোপের সেই প্রবল আধিপত্যের মাঝেই সুইডেনের অলিতে গলিতে ব্রিটিশ ও ইউরোপের মিডিয়া একটা ব্যাঙ্গাত্মক প্রবাদ রটিয়ে দিল ইউরোপের মাটি থেকে কোনো লাতিন আমেরিকার দল কাপ নিয়ে যেতে পারবে না। এ কথা সত্যি যে তার আগে কেউ পারেনি।

উরুগুয়ে দুবারের চ্যাম্পিয়ন সেবার সুযোগই পেল না খেলার। শিবরাত্রির সলতের মতো আর্জেন্টিনা কিছুটা জ্বলছে, লাতিন আমেরিকার দিকে এই প্রবল অপমানটা ছোঁড়ার পিছনে একটা সূচারু প্ল্যানিং ও ছিল ইউরোপিয়দের৷ কিন্তু ব্রাজিল কোথায়? ছিয়াশির ম্যারাডোনার ক্লাইম্যাক্স সিনের চেয়েও কিছুটা আনপ্রেডিক্টেড ভদ্রলোক ব্রাজিলকে নিয়ে এলেন ইউরোপে।

মোটাসোটা গোলগাল। নাম ভিসেন্তে ফেওলা। কার্লোস বিলার্ডো যদি ছিয়াশির আর্জেন্টিনায় মারাদোনার রিংমাস্টার হন তাহলে ফেওলাকে কী বলা যেতে পারে? সুইডেনে ফেওলা গিয়ে ঘোষণা করে দিলেন ব্রাজিল খেলবে ৪-২-৪ ছকে। পাত্তাই দিল না কেউ। তিন ব্যাকের স্টেবল ডিফেন্সের সেবেচীয় তত্ত্বে তখন মজে দুনিয়া।

ব্রাজিলের প্র‍্যাকটিসে ভিড় হচ্ছে একজনের জন্যেই। জোসেফ আলতাফিনি। এসি মিলানের ঊনিশ বছর বয়সী তারকা৷ কিন্তু আলতাফিনিকে নিয়ে হইচই হলেও ফেওলা দুটো বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অওড়ে থাকছিলেন প্র‍্যাকটিসে৷ সতেরো বছরের অ্যাডসন আরেন্টাস ডো ন্যাসিমেন্টো, সাও পাওলোতে যাঁকে অনেকে ডাকেন পেলে বলে। আর একজন ম্যানুয়েল ফ্রান্সিসকো ডোস স্যান্টোস। ছোটো করে বললে গ্যারিঞ্চা। আর একজনের নাম না করলে অন্যায় হবে, তিনি মারিও জাগালো।

প্রবল গোঁয়ার্তুমি শুরু করে দিলেন ফেওলা। লুইজিনহোকে বাদ দিয়ে দিলেন, ৪-২-৪ এ খেলবেন বলে ব্রাজিলের জনতাকে ক্ষেপিয়ে দিলেন আর জেদ করে সতেরো আর উনিশ বছরের দুটো ছেলেকে দলে রাখলেন৷ ফেওলাকে টিটিকিরি মেরে কার্টুন আঁকা হয়ে গেল পত্রিকায়। তবু লোকটা ভয়ানক একগুঁয়ে।

তিনব্যাকে খেলার সময়ে ডিফেন্স কভার করতে কেউ পিভট হতেন না ব্রাজিলে ফলে সিঙ্গেল স্টপারের ওপর চাপ পড়ত প্রবল। লেফট হাফকে নামিয়ে আনলেন সেন্টার ব্যাকে। ব্যস, চার ব্যাকেই দল নামাবেন বলে টেবিল চাপড়ে উঠে গেলেন ফেওলা। বিলার্ডো ম্যারাডোনাকে রাখার জেদে হারিয়েছিলেন পাসারেল্লাকে, চোটগ্রস্থ ম্যারাডোনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড আর সুইডেনে ফেওলা নিয়ে এলেন হাঁটুর হাড়ে চিড় খাওয়া পেলেকে।

বাকিটা ইতিহাস। গোথেনবার্গে প্রথম ম্যাচটাতেই পেলে যখন মাঠে নামলেন তখন তিনি যেন ঘূর্ণায়মান প্রাচীন গ্যালাক্সির কোনো তারকা, সদ্য নোবেলজয়ী আলব্যেয়ার কাম্যুর মতো কোনো দার্শনিকের কল্পনায় যেন তিনি নেমে এসেছেন মাটির পৃথিবীতে। গ্যারিঞ্চার লিটিল বার্ড উপাধিটাও যেন হলদে পাখির মতো ভাসছে সুইডেনের আকাশে বাতাসে। বিশ্বের ইতিহাস বলে এভরিওয়ান হ্যাস দ্যা ফায়ার বাট দ্যা চ্যাম্পিয়নস নো হোয়েন টু ইগনিট দ্য স্পার্ক!

পেলে-গ্যারিঞ্চা-জাগালো-ভাবা-জিটোর ব্রাজিল, স্বপ্নের ব্রাজিল, ফেওলার ব্রাজিল, অবিশ্বাস্য ব্রাজিল, অদম্য ব্রাজিল। ছিয়াশির ম্যারাদোনা, চুরানব্বই-এর বাজ্জিওর মতো নিউক্লিয়ার রূপকথার সমান্তরালে আটান্নর ব্রাজিলের বিশ্বজয় অনেকটা ফুটবলের আদিম ভাষার ওপর ইউরোপিয়ানদের আধিপত্যের ছায়াকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো।

আটান্নর আগে যেভাবে ইতালি-হাঙ্গেরি-পশ্চিম জার্মানির গতি আর সুচতুর প্ল্যানিং-এর হাতে চলে যাচ্ছিল ফুটবল ব্রাজিল আটান্নয় শুধু প্রথম বিশ্বকাপই জিতল না, এই ইউরোপীয় ফুটবল স্ট্র‍্যাটেজির একেবারে পালটা একটা স্ট্র‍্যাটেজি খাড়া করতে পেরেছিল বিশ্বের সামনে। পেলে-জাগালো-গ্যারিঞ্চার ছন্দময় ফুটবল খেলতে পারার পিছনে ভিসেন্তে ফেওলার অদম্য জেদ আর ফর্মেশনের কারিগরিটা অনেক সময়েই হয়ত ঢাকা পড়ে যায়।

ফাইনালে ব্রাজিলের পঞ্চম ও পেলের দ্বিতীয় গোলের পর মাঠেই কাঁদতে থাকেন পেলে। সাও পাওলোর রাস্তা থেকে স্টকহোমের রঙিন পৃথিবীতে তাকে টেনে এনেছিল তাঁর গগনচুম্বী প্রতিভা আর ফেওলার নি:স্বার্থ বিশ্বাস। ফাইনালের পর সুইডেনের ডিফেন্ডার সিজ্জে পার্লিং বলেছিলেন- ‘আমি খুব ভাগ্যবান এমন ক্ষণজন্মা প্রতিভার বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পেয়েছি…’

ফেওলার হাত ধরে যেমন ব্রাজিল আটান্নয় ইতিহাস লিখেছিল আবার ছেষট্টিতে এই পেলের প্রতি বিশ্বাসে তিনি আহত পেলেকেই নামিয়েছিলেন, ব্রাজিল সেবার হেরে যায় বাজে ভাবে। ফেওলাও আর কোনোদিন কোচিং করান নি। আদিম কালের চাঁদিম হিম, তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম- আচমকা সুকুমারীয় পৃথিবীতে ফেওলা আর পেলের এই বিশ্বাসে সুতো একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল।

ইউরোপের সাজানো বাগানে মহুল হয়ে ফুটেছিল লাতিন আমেরিকান ফুটবলের কুঁড়ি। অ-ইউরোপীয় দল হিসেবে ইউরোপের মাটি থেকে প্রথম বিশ্বকাপ লাতিন আমেরিকায় এনেছিল ব্রাজিল। পরের কয়েকদশক বিশ্বফুটবলে লাতিন আমেরিকান আধিপত্যের বীজটা আটান্নয় বুনে দিয়েছিল ব্রাজিল। বিপ্লব এভাবেই আসে। প্রেমে। আনন্দে। হরষে। মহাসমারোহে। বিশ্বাসেও বটে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...