টাকার অংকে ১৭ হাজার কোটি টাকা সাধারণ একজন থেকে শুরু করে ধনীদের জন্যও অনেক বড় অর্থ। কিন্তু যার নামের পাশে একজন ‘ধনকুব’ লেখা আছে তার কাছে এই অর্থ তেমন বিষয় নয়। যেমন করে রোমান আব্রামোভিচের কাছে যেন এই টাকাটা অনেকটা হাতের ময়লার মতো। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অন্য অনেক নামের পাশে এই নামটিও উচ্চারিত হচ্ছে।
বিশেষ করে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ’বিশেষ’ সখ্য থাকার কারণে নানাভাবেই চাপের মুখে রয়েছেন তিনি। একসাথে তিন দেশের নাগরিক আব্রামোভিচের জন্য গলার কাটা হয়ে আছে চেলসি। নিজ দেশ রাশিার মতো ইসরায়েল ও পতুর্গালের সেরা ধনীদের একজন তিনি। কিন্তু পুরো জীবনে এতটা চাপের মুখে কখনোই পড়েননি।
যদি বলা হয় পড়তে হয়নি তাহলে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবেনা। যে ১৭ হাজার কোটি টাকা দিয়ে লেখাটির শিরোনাম করা হচ্ছে সেখানেও রয়েছে এই ধনী মানুষটির নাম। অনেকটা লোকসানে থেকেই অনেক স্বপ্ন নিয়ে কেনা ক্লাব চেলসিকে বিক্রি করে দিতে চাইছেন। কারণ যে পরিস্থিতি দাড়িয়েছে তাতে করে আর কখনো ইংল্যান্ডে প্রবেশের সুযোগ হয়তো পাবেন না তিনি।
সে কারণে কষ্টটা মেনে নিয়েই একরকম ঘোষণা দিয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবটিকে বিক্রি করে দেওয়ার। ১৭ হাজার কোটি টাকা পাওনা মাফ করেই বিক্রি করে দিতে চান চেলসিকে। ইংলিশ ক্লাবটিকে প্রায় দুই দশক ধরে রাশিয়ান মালিকই দেখভাল করতেন। কিছুদিন আগেই তিনি ক্লাবের সবরকম দায়িত্বও ছেড়ে দিয়েছিলেন।
এবার সর্বশেষ মালিকানাই ছেড়ে দিচ্ছেন। লন্ডনভিত্তিক ক্লাব চেলসির ওয়েবসাইটে দেওয়া বিস্তারিত এক বিবৃতিতে সিদ্ধান্তের কথাটি জানান আব্রামোভিচ। পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়ায় আরও কয়েক বছর আগে থেকেই বর্তমান রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতার বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। যদিও নিজে সবসময় এটাকে গুজব বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এর আগে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে আব্রামোভিচের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের জোর দাবি ওঠার পর চেলসির ‘অভিভাবকত্ব’ চেলসিরই চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন ৫৫ বছর এই ট্রিলিয়নার। এরপর থেকে যখন ইউক্রেনে রাশিয়ান হামলা জোরদার করা হচ্ছিল তখন থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, চেলসি চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন ক্লাবটির দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হচ্ছেনা।
এ সময়ই আব্রামোভিচ ক্লাব বেঁচে দিতে পারেন বলেও গুঞ্জনের ডালপালা মেলেছিল। অবশেষে সেই গুঞ্জনই সত্যি হতে চলেছে। ক্লাব বিক্রি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আব্রামোভিচ বলেন, ‘চেলসিকে অনেক ভালবেসে কিনেছিলাম। আমি সবসময় মন থেকে ক্লাবের সবচেয়ে ভালোর জন্য সব সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি। এই পরিস্থিতিতে তাই আমি ক্লাবকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো কঠিন আর কষ্টদায়ক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, ক্লাব, সমর্থক, সব স্টাফ এবং একই সঙ্গে ক্লাবের স্পন্সর ও পার্টনারদের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো হতে যাচ্ছে।’
আব্রামোভিচ ২০০৩ সালে চেলসির মালিকানা কিনে নিয়েছিলেন। তার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দারুণ সব সাফল্য পেয়েছে ক্লাবটি। প্রিমিয়ার লিগে তাঁরা যে ছয়টি শিরোপা জিতেছে তার পাঁচটিই এসেছে এই সময়টাতে। দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপার সবকটিই এসেছে তার মালিকানায়। প্রথমটি ২০১১-১২ মৌসুমে এবং পরেরটা ২০২০-২১ মৌসুমে। তাহলে সামনে আবারো কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে চেলসিকে, এই রকম কথা বলাবলি শুরু হয়ে গেছে। কারণ ধনকুবের ছাড়া ক্লাব পরিচালনা করা অনেক কঠিন।
এদিকে রাশিয়ার আক্রমণের কারণে দেশটি ক্রীড়া ক্ষেত্রে এরই মধ্যে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিশেষ করে ফুটবল, ভলিবল, রাগবিসহ অনেক খেলাতেই এসেছে নিষেধাজ্ঞার মতো সিদ্বান্ত। যার শুরুটা হয়েছিল সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে চলতি মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল প্যারিসে সরিয়ে নেওয়া। এরপর রাশিয়ার সকল ক্লাব ও জাতীয় দলকে সব ধরনের প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রা সংস্থা ফিফা ও ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা উয়েফা।
ক্লাব বিক্রির ঘোষণার আগে অবশ্য গুঞ্জন ছিল, তার দেশ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর যুক্তরাজ্য সরকার তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে ইংল্যান্ডের মাটিতে। এখানেই শেষ নয়, সে দেশে তার সব ধরনের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করতে পারে, এমন কথাও শোনা গিয়েছিল। সেটা হয়ে গেলে তার চেলসিও বাজেয়াপ্তের আওতায় পড়ত সেই নামী-দামী ‘সম্পদের’।
যার ফলে ক্লাব সম্পত্তি বিক্রি করার পথ বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু সেই সুযোগটা ইংলিশদের দিলেন না অতি চতুর এই মানুষটি। আর সে কারণে কিছুটা আগেভাগেই ক্লাব বিক্রির ঘোষণাটা দিলেন আব্রামোভিচ। প্রায় কুড়ি বছর আগে ১৪ কোটি পাউন্ডে কিনে নেওয়া চেলসিকে বিভিন্ন মেয়াদে দেওয়া ধার বাবদ ১৫০ কোটি পাউন্ড পাওনা ছিল এই রাশানের।
বাংলাদেশি মুদ্রায় যে অংকটা দাড়ায় ১৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকারও বেশি! যারা ব্যবসায়ী তারা নিশ্চয়ই এত বড় পরিমানের অর্থ মাফ করে দিতে চাইবেন না। কিন্তু বড় ধরনের বিপদ আচ করতে পেরে অনেকটা অসহায় আত্বসমর্পনের মতোই চেলসিকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো সিদ্বান্ত নিতে হয়েছে তাঁকে। তবে ক্লাব বিক্রির ক্ষেত্রে কোন প্রকার তড়িঘড়ি না করে যথাযথ নিয়ম মেনেই করা হবে বলে জানিয়ে রেখেছেন আব্রামোভিচ। এর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সব পাওনা মওকুফের বিষয়টিও চলে আসে।
তবে, চমক হিসেবে ক্লাব বিক্রি করে পাওয়া অর্থ ইউক্রেনে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে, ‘চেলসিকে কেনার পর থেকে থেকেই আমি আমার দলকে নির্দেশ দিয়েছি যাতে একটা দাতব্য ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা হয়। আর যেখানে ক্লাব বিক্রি করে পাওয়া সব অর্থ দান করে দেওয়া হবে। এই ফাউন্ডেশন হবে ইউক্রেনে যুদ্ধের শিকার সবার সাহায্যের জন্য একটি বড় প্লাটফর্ম। এছাড়া এই সাহায্যের মধ্যে যুদ্ধের শিকার মানুষের জরুরি ও তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর কাজটিও করা হবে।’
চেলসির দায়িত্ব নেওয়ার পর দারুণভাবে বদলে দেওয়া ক্লাবটিকে লিগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের পাশাপাশি পাচঁটি এফএ কাপের শিরোপাও জিতিয়েছেন।