নিন্দুকের নিন্দা এক সময় থেমে যায়। সেই নিন্দাগুলো ধুলোয় মিশে নতুন এক বৃক্ষ হয়। সেই বৃক্ষের প্রতিটা কাণ্ডে বাসা বাঁধে প্রশংসা। কোন এক শীতে সেই প্রশংসা ঝড়ে পরে ক্লান্ত শ্রান্ত পথিকের গায়ে। হয়ত সে পথিক পাকিস্তানের ইমাম-উল হক। চোখে চশমা গলিয়ে, সাজসজ্জা শেষে তিনি নেমে যান বাইশ গজে। সেখানে ব্যাটের আঘাতে ধূলায় মেশান নিন্দা। দিনশেষে ক্লান্ত ইমাম ভাসেন প্রশংসায়।
ইমাম-উল হক পাকিস্তানের সাবেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার ইনজামাম উল হকের ভাতিজা। চাচা একসময় পাকিস্তানের ভরসার প্রতীক ছিলেন। ব্যাট হাতে তিনি বহু ম্যাচ জিতিয়েছেন পাকিস্তানকে। পাকিস্তান ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি হয়ত উজ্জ্বলতম এক তারকা হয়েই বিবেচিত হয়ে আসবেন চিরকাল। সেই চাচার কাছ থেকেই হয়ত অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ক্রিকেটকে ভালবাসার। সেই চাচাই হয়ত শিখিয়েছিলেন ক্রিকেটের খুঁটিনাটি।
তবে তিনি যে নিজ যোগ্যতায় খুঁজে পেয়েছেন পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের ঠিকানা তা যেন মানতেই নারাজ গুটিকতক সমর্থকরা কিংবা বলুন নিন্দুকেরা। তাঁদের তত্ত্বের সূত্র স্বজনপ্রীতি। তাঁরা সবাই বিশ্বাস করতেন চাচা ইনজামামের প্রতাপ তাঁকে জায়গা করে দিয়েছে পাকিস্তান জাতীয় দলে। কিন্তু কি আসলেই তাই?
ইমাম-উল হকের পারফর্মেন্স অন্তত সেই মতবাদকে সমর্থন করেনা। ২০১৭ সালে ওয়ানডে দলে প্রথম ডাক পেয়েছিলেন তিনি। সে সময় অবশ্য তাঁর চাচা ইনজামাম উল হক ছিলেন প্রধান নির্বাচক। নিন্দার শুরুর কারণ বোধহয় ছিলো সেটাই। তবে ইমাম নিজেকে প্রমাণ করলেন। প্রথম নয় ইনিংসের চারটিতে করলেন সেঞ্চুরি। তবুও যেন সমালোচনার তীব্র বানের আঘাত কমেনি।
সময় পরিক্রমায় টেস্ট দলের হয়ে লাল বলের ক্রিকেটটা খেলার সুযোগ হয়ে গেলো তাঁর। সেখানেও তিনি সামর্থ্যের প্রমাণ রাখলেন। আয়ারল্যান্ডের কঠিন কন্ডিশনেও ব্যাট করে তিনি তুলে নেন দুইটি হাফ সেঞ্চুরি। তবুও যেন বন্ধ হওয়ার খবর নেই নিন্দা। ষোলকলা পূর্ণ হয় মিসবাহ-উল হক যখন প্রধান নির্বাচক হয়ে আসেন ২০১৮ সালে। তখন টেস্ট দলের শুরুর একাদশে ইমামের সুযোগ কমে যেতে শুরু করে।
এমন অবহেলা এবং নিন্দা যেন ইমামকে বানিয়েছে আরো শক্ত, আরো পরিপক্ক। সে প্রমাণই তিনি রাখলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠে। সুদীর্ঘ ২৮টি বছর বাদে ক্রিকেটের পরাশক্তিকে আতিথিয়তা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি পাকিস্তান ক্রিকেট। সেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দারুণ এক ইনিংস খেললেন ইমাম। অস্ট্রেলিয়ার মতো ওমন বিধ্বংসী এক বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে কি সাবলীল এবং ধৈর্যশীল ইনিংস খেলে নিজের পরিপক্কতার প্রমাণ রেখেছেন তিনি। আর তাঁর চূড়ান্ত প্রমাণ মিললো এক বিস্ফোরণ দিয়েই।
নাথান লিঁওর মতো কোয়ালিটি স্পিনারকে সামলেছেন। তাছাড়া মিশেল স্টার্ক, জশ হ্যাজেলউড ও প্যাট কামিন্সের মতো পেসারদের সব বাউন্সারকে ধৈর্য্য ধরে সমলেছেন। মজার একটা পরিসংখ্যান দেই। তিনি ৬১টি শর্ট বল সামলেছেন। এরমধ্যে কেবল ১১টি বলে তিনি রান নেওয়ার প্রচেষ্টা করেছেন এবং রান করেছেন ১৫টি। চিন্তা করুণ ঠিক কি পরিমাণ পরিপক্কতা নিয়ে তবে এমন বিশ্বমানের পেসারদের সামলে নিতে হয়। নিজেকে প্রমাণের একটা সুযোগও আর হেলায় হারিয়ে যেতে না দিতে বদ্ধপরিকর ইমাম।
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে তিনি দুইটি দিন ব্যাটিং করেছেন। ৩৫৮ বল খেলেছেন লিঁও, স্টার্ক, কামিন্সদের বিপক্ষে। বাইশ গজের ছিলেন ৫২৯ মিনিট। ঘন্টার হিসেবে যা কিনা প্রায় নয় ঘন্টার খানিক বেশি। টেস্ট টেম্পারমেন্টের পূর্ণ প্রদর্শন করে কেবল দুইটি ছক্কা মেরেছেন। নিজের নামের পাশে ১৫৭ সংখ্যাটা লিখিয়েছেন।
তিনি যেন তাঁর সেই নিন্দুকদের নিন্দার জবাবটা ব্যাট হাতেই দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি হয়ত বারংবার এমন করেই প্রমাণ করে যাবেন যে তিনি স্বজনপ্রীতির জোরে আসেননি পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলে। তিনি এসেছেন যোগ্যতায়। সেই যোগ্যতার সাথে নতুন করে পরিপক্কতা যুক্ত করে তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে সংকল্পবদ্ধ। তিনি নিন্দুকের নিন্দার ঊর্ধ্বে ওঠার অপেক্ষায়।