মিরাজের উত্থান বনাম চার পেসার

মেহেদী হাসান মিরাজের উত্থান এবং এই সফরে বাংলাদেশের দলে কেন ৪ জন পেসার খেলানো দরকার সেটা মিরাজকে দলে রেখেই খেলাতে হবে!

সম্ভবনাময় ক্রিকেটারদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে মিরাজ কখনোই আমার তালিকায় খুব একটা উপরে ছিলে না। তাঁর ওপর ২২ গজ বা মাঠের বাইরে তার ব্যক্তিত্বের খুব একটা সমর্থক কখনোই হতে পারি নাই। তবে শেষ বছর খানেকের পারফরম্যান্সের প্রেক্ষিতে একটা কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় আমরা মিরাজের উত্থান উপভোগ করতেছি। শেষ কিছু সিরিজে মিরাজকে খুব বেশি উপভোগ করেছি। ২০১৬ সালে মিরাজকে নিয়ে অনেকের মধ্যে যে আশাটা ছিল সেই দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন মিরাজ।

ব্যাটিং এর ঝলকানি তরুন অবস্থাতে দেখালেও, ধুমকেতুর মতো বোলিং করে তারা অনেকটা বোলিং তারা হওয়ার স্বপ্ন জেগেছিলো। ২০২১ থেকে মিরাজের পারফরম্যান্সের গ্রাফটা উপরে দিকে। ২০২১ পরবর্তী টেস্টে ১৪ ইনিংসে ১ টা সেঞ্চুরি, একটা ফিফটির সাথে আছে তিনটা ত্রিশোর্ধ ইনিংস। যা তার ব্যাটিং পজিশন অনুযায়ী সমীহ জাগানোর মতোই পারফরম্যান্স।

ওয়ানডে ব্যাটিংটা টেস্টের মতো সমীহ জাগানোর মতো না হলেও আস্তে আস্তে সেটায়ও কনফিডেন্স পাচ্ছেন।আফগানিস্তানের সাথে তার ইনিংসটা তার ইফেক্টিভ হওয়াটাই জানান দেয়। কালকের তার ক্ষুদ্র ইনিংস তিনি কার্যকরী হয়ে উঠছেন তার বার্তা দেয়। ১৩ বলে ১৯ রানের ইনিংস ভালো ছিলো। ২ টা দারুন ছক্কা। ১৩ বলের কখনোই তাকে মনে হয় নি তিনি সেই আগের নড়বড়ে হাঁটু কাপা মেহেদী মিরাজ। আফগানিস্তানের সাথে ইনিংস তার ব্যাটিং কনফিডেন্স যে আপ করছে তার প্রমান কালকের ক্যামিও।

মিরাজ তার ব্যাটিংটা নিয়ে প্রচুর খেটেছেন। প্রচুর কাজ করেছেন সেটা দৃশ্যমান। মিরাজকে নিয়ে আরেকটা বড় প্রশ্ন ছিলো বিদেশে বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে এশিয়ার বাইরে তার বোলিং ঠিক কতটা চলে?

এই জায়গায় অবশ্য মিরাজ অনেকটা পরীক্ষা দিয়ে অনেক কিছুই করে দেখানো বাকি। তবে একটা সময় যেমন এশিয়ার বাইরে মানেই মিরাজকে নেয়াই যাবে না কোনওভাবে যে রবটা উঠতো সেটা বোধহয় আর দেয়াটা উচিত হবে না। না হওয়ার কিছু কারনের অন্যতম হচ্ছে বিকল্প তেমন কোনও স্পিনার না থাকাটা। দ্বিতীয়ত হচ্ছে মিরাজ বল হাতে রেসপন্স করতেছে বা তাঁকে দিয়ে রেসপন্স করানো হচ্ছে।

মিরাজের বিদেশে একক নৈপুণ্যে সাফল্য পাওয়া এখনও কঠিন একটা ব্যাপার হলেও। আপনি যদি মিরাজকে ঠিক মতো ব্যাবহার করতে পারেন আপনি মিরাজ থেকে আউটপুট পাবেন। যেমনটা কালকে তামিম আফ্রিকা ম্যাচে পেয়েছেন। মিরাজ যতটা না ভালো বল করেছেন তামিম তার চেয়ে উপযুক্তভাবে তাকে শেষ দিকটায় ব্যাবহার করেছেন। টু গুড ক্যাপ্টেন্সি ছিল।

নিউজিল্যান্ডের সাথে জয় পাওয়া ম্যাচটায় ২ ইনিংস ৪ টা উইকেট পান। প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট ঝটপট পান, খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। তাকে ঐ দিনেও ঠিক সময়ে বলটা দেয়া হয়।

মিরাজের আরেকটা বিষয় উন্নতি পাইছে সেটা হচ্ছে নার্ভের ব্যাপার। তামিমের দুর্দান্ত ব্যাবহারে শেষ দিকে সাফল্য পেলেও প্রথম স্পেলে খুব খারাপ বল করার পরও মাথা ঠান্ডা রেখে, লেন্থ ঠিক রেখে বল করাটাও কঠিন একটা কলা। সেই কাজটা বেশ ভালোভাবেই করতে পারেন।

ফিল্ডার হিসাবে সে খুবই এনার্জেটিক। মাঠে ভালো ফিল্ডিং তো করেন সবসময় চাঙ্গা থাকেন। পজিটিভ একটা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থাকে। এইরকম ক্যারেক্টার মাঠে থাকলে বোলররাও ইন্সপায়ার্ড হয়।

শেষ ১-১.৫ বছরের পারফরম্যান্স অনুযায়ী মিরাজকে কোটাপূরন করতে পারা একজন বোলার বলতে রাজি না। মিরাজ এখন প্রায় “প্যাকেজ টাইপ” ক্রিকেটার। এই প্যাকেজ টাইপের ক্রিকেটার খুবই ইফেক্টিভ হন বর্তমান সময়ে ক্রিকেটের জন্য। জিমি নিশাম, অক্ষর প্যাটেল, মার্কস স্টয়নিস, মইন আলী, শাদাব খান, দাসুনা শানকা, ফেলুকায়ো। ওডিআইতে এদের ব্যাটিং অলরাউন্ডার বলতে গেলে এরা কি এতটাই ভালো ব্যাটার বা বোলিং অলরাউন্ডার হলেও প্রশ্ন থাকবে এতটা ভালো বোলার কি না? তবে এরা দলে পারফেক্ট ব্যালেন্স করেন। এই ব্যালেন্সটা ঠিক বাংলাদেশের জন্য হতে পারেন মিরাজ!

ফিল্ডিং ব্যাটিংটা এতই ভালো করছেন সাথে তাঁর বোলিংটা যোগ করলে ব্যালেন্স ম্যান হিসাবে তাঁকে দলে রাখা যায়।

তবে কালকে যদি তিনি ম্যাচ বাংলাদেশ কোনওভাবে হারতো এই ম্যাচ হারার পিছনে সহজ টার্গেটটা মিরাজ হতেন। কেন বাংলাদেশ চার পেসার নেয় নি? আফ্রিকা যেখানে ১ স্পিনার খেলায় সেখানে আমারা কিভাবে ২ স্পিনার খেলাই সেটাই আলাপ হইতো।।ডোমিঙ্গোর মুন্ডুপাত হইতো। সব জায়গায় দাবি থাকতো মিরাজের বাদ পড়ার।

বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের চার পেসার দরকার। তিন পেসার নিয়ে খেলাটা এই মূহূর্তে বাংলাদেশের জন্য খারাপ। কিন্তু এই চার পেসার নিতে গিয়ে মিরাজকে ড্রপ করারও পক্ষপাতি নই। গতদিন একজন জানতে চেয়ে ছিল কেমন একাদশ দেখতে চাই! সেই একাদশে চারজন পেসার রেখেছিলাম। কারন হিসাবে জানিয়ে ছিলাম এই পিচ এবং মাঠে সাকিব মিরাজের ২০ ওভার একসাথে ইফেক্টিভ নাও হতে পারে। একজন বাড়তি পেসার থাকলে হেল্পফুল হবে এই ২০ ওভারের মধ্যে।

আর কিছুটা মিলেও গেল। দুইজনই তাদের করা প্রথম ১৫ ওভারে সেইরকম ইভেক্টিভ ছিলেন না, তাদের যেভাবে আমরা দেখি। শেষ ৪ ওভারে তামিমের বিচক্ষনতা, স্কোর বোর্ডের চাপ , মিরাজের নিজেকে ধরে রেখে শেষ কয়েক ওভার দারুন করছেন। বড় ব্যবধানের জয়ের ব্যাবধানটা এইখানে হইছে। এখানে সব কিছু উল্টা হলে এই ২০ ওভারই হয়তো বাংলাদেশের হারের কারন হতো!

তাসকিন ডুসেনকে আউট করে ব্রেক থ্রু দেয়ার আগে অবধি মনে হচ্ছিলো তামিম বাকি ওভার গুলো কিভাবে কাকে দিয়ে করাবে!

এশিয়ার বাইরে ৪ পেসার খেলানোর আরও কিছু কারণ কালকে পেয়েছি। প্রথমটা হচ্ছে তাসকিন আহমেদ। তাসকিন পাওয়ার প্লে – মিডিল ওভারে দুর্দান্ত বল করেন। তবে স্লগে আবার নিজেকে হারায় ফেলান। কিন্তু মিডিল ওভারে এতই দুর্দান্ত সাথে যেভাবে ব্রেক থ্রু দেন তাতে মনে হয় না তার রোল বদলিয়ে তাকে জোর করে ডেথেও আনা উচিত না। শেষ আফগান সিরিজেও তাকে এভাবে ব্যবহার করা হইছে।৩৫ ওভারের মধ্যে ওর বোলিংটা শেষ করানো হয়।

দেশের মধ্যে এটা সমস্যা হয় না। সাকিব মিরাজরা খুব দক্ষতার সাথেই ৪০ এর পরেও ৩-৪ ওভার করতে পারেন। কিন্তু বিদশে ৪০ এর পর স্পিনার খুবই রিস্কি সিদ্ধান্ত। বিদেশের পিচ তাদের জন্য পারফেক্ট না। ইভেন সেটা সাকিবেরও জন্যও।

তাসকিনের ওভার শেষ হওয়ার পর ৪০-৫০ ওভারের মধ্যে বাকি দুই পেসার হয়তো ৬-৭ ওভারই থাকে। বাকি ৩-৪ টা ওভার পুরোটাই স্পিনারকে করতে হয়।

এক্সট্রা এই চতুর্থ পেসার থাকলে এই ৩-৪ ওভারে সাপোর্ট পাওয়া যায়। তার সাথে মিডিল ওভারে সহ বাকি দুই পেসারের সাথে মিলিয়ে বেশ ভালো করে সাজানো যায়। মুস্তাফিজের কনসিসটেন্সির অভাবটাও আছে। সব মিলায়ে দিন খারাপ যাওয়া কোনও বোলারের সাথে রোটেটও চালানো যায়।

তো এই চার পেসার খেলাইতে মিরাজকে বাদ দেয়ার দরকার নাই। আপনি বাকি ওডিআই দলগুলোরে দেখেন। তারা কিভাবে একাদশ বিল্ড করে কিংবা তাদের বোলিং এর ৫০ ওভার কভার করে।

৪ জন তারা জেনুইন বোলার নেন সাথে ৭ নম্বরে এই রকম টিম ব্যালেন্স করা প্যাকেজ ক্রিকেটার রাখেন। আমাদের দলটা এই খানে ভাগ্যবান। আমরা ৩ জেনুইন বোলার নিই সাথে প্যাকেজ হিসাবে কখনো সাইফুদ্দিন কখনো মিরাজকে দলে নেই। আমাদের ভাগ্যটা সবচেয়ে ভালো যে এই দলে সাকিব আছে। ব্যাটসম্যান অর্ডারে থাকা সাকিব জেনুইন ১ জন বোলারও। এইভাবে আমাদের বোলিং ৫০ ওভার কভার হয়।

সাকিবকে সরায় ফেললে আপনার চার জন জেনুইন বোলার সাথে এইরকম প্যাকেজ টাইপের কাউকে নিতে হবে। চারজন জেনুইন বোলার সাথে মিরাজকে রাখতে খুব একটা আপত্তি আসার কথা না তাই।যেই মিরাজ থেকে সবকিছুই একটু আকটু করে পাবেন।

আর ২০২১ আইসে এত লম্বা ব্যাটিং লাইন নিয়ে  ওয়ানডে কোনো কারণ নেই। এত ডিফেন্সিভ মাইন্ড থাকলে এইসব বিদেশ সফর বাদ দিয়ে ঘরে বসে পাপুয়া নিউগিনির সাথে ক্রিকেট খেলা উচিত।

আর এমনিও লিটন তামিম সাকিবের মতো টপ ক্লাস ক্রিকেটার টপ অর্ডারে, মুশফিক যে কিনা রস টেইলরের পর এই যুগের অন্যতম সেরা নাম্বার ফোর, পাচেঁ ইয়াসির আলী। এরপরও ৭ আফিফ কিংবা রিয়াদকে রাখার দরকার দেখি না। এই পজিশনে মিরাজ মোর দ্যান এনাফ! জেনুইন ব্যাটারকে পৃথিবীর কোন দল নম্বর ৭ এ খেলায়?

আর এমন কাউকে খেলাচ্ছেন যে ৭ এসেই ধোনি বা বেভান হবেন। আফিফ হোসেন যিনি স্লগার না কিংবা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ যিনি ইতমধ্যেই ফিনিশড ক্রিকেটার।এইটা হচ্ছে শুধুই পজিশন নষ্ট আরকি। জোর করে একটা পজিশন বাড়ানো

রিয়াদ গতদিন খারাপ খেলেন নাই। তারপরও বাংলাদেশ জাতীয় দলের সবেচেয়ে উইক লিংক বর্তমানে রিয়াদই। ফিল্ডিং তো পুরাই দিশেহারা অবস্থা তার। ব্যাটিং ঠিক সুবিধার জায়গায় নাই একদমই। আফিফ মিরাজ তারা রিয়াদের আগে আসা এমনিতেই ডিজার্ভ করেন। ব্যাটিং প্রায় ঘুমন্ত। যেদিন দরকার পরে সেদিন জাগে না,যেদিন জাগে সেদিন দলের দরকারই পড়ে না।

মিরাজের ১০ ওভার বোলিং করতে পারবে এটা ভুলেও যদি চিন্তা করি। মিরাজ ৫ ওভার করবে+ ব্যাটিং+ ফিল্ডিং সাথে রিয়াদ এবং আফিফের তুলনা করে প্রশ্ন করি কোন দুইজনকে একাদশে রাখবেন?

আমি তো আফিফ এবং মিরাজকে নিবো এই তিনজন থেকে ২ জন নেয়ার অপশন থাকলে। আফিফ ব্যাটসম্যান হিসাবে রিয়াদের চেয়ে ভালো। মিরাজ প্যাকেজ হিসাবে রিয়াদের চেয়ে টিমে ভূমিকা রাখতে পারবে বেশি।আর এতে দলের উইক লিংকটা ঢাকা যাবে। সবচেয়ে সুবিধা হতো এই স্কোয়াডে যদি মৃত্যুঞ্জয় বা সাইফউদ্দিনের কেউ থাকতো। ব্যাটিং নিয়ে অতিরিক্ত চাপ নেয়া মানুষ স্বস্তি আরও বেশি হতো। তবে তারা যখন নাই এবাদত কিংবা শহিদুল একটা অপশন হতে পারে দলের জন্য।

রিয়াদ বাদ দিবে না ২০২৩ এর আগে এটা জানি, তারপরও এটা বাদ দেয়া না। দলের স্বার্থে বিদেশে ২ টা ম্যাচে বেঞ্চে থাকলে সন্মান যাবে না।দেশে দরকার হলে তাকে আবার দলে নিবে। যদিও তাকে বসানোর সাহস ইচ্ছা কোনটাই অধিনায়ক এবং ম্যানেজমেন্টের নাই। তারপরও চাই সামনের ওডিআইতে চার পেসার আসুক মেহেদীকে সঙ্গে নিয়েই। রিয়াদকে ছাড়া আগাইতে না পারলে অন্য কাউকে বাদ দিয়েই চার পেসার আনুক মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে।

ক্রিকেটে বড় একটা দেশে গিয়ে ওয়ানডে সিরিজ জেতা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সাফল্য। রিয়াদকে রেখে যদি দুই একটা আনফেয়ার স্যাকরিফাইস করে সেটাও মেনে নিতে আপত্তি নাই।যদিও বাংলাদেশে ক্রিকেট বুকের রুলস অনুযায়ী উইনিং কম্বিনেশন ভাঙ্গা যায় না। তবে সিরিজ জিততে হবে। ২০২২ ক্রিকেটে বাংলাদেশের যে মোমেন্টামটা আছে সেটা অব্যাহত রাখতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link