আজকাল সবকিছুই অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী – খ্যাতি, অখ্যাতি, আমাদের স্মৃতি। কয়েকদিন আগে ঋষভ পন্থকে নিয়ে ক্রিকেটের শেয়ার মার্কেট সরগরম ছিল। গত দুই দিনে সেই স্থান গ্রহণ করে নিয়েছেন বাবর আজম। এই পরিস্থিতিতে এমন একজন ক্রিকেটার যার সেরা সময় বছর দুয়েক পেছনে ছিল তাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠবে সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কতদিন আর অতীতকে ভাঙিয়ে চলবে!
যারা একটু আধটু ক্রিকেট খেলেছেন বা দেখেছেন তারা জানবেন একজন ব্যাটসম্যানের সবচেয়ে কঠিন সময় হচ্ছে ইনিংসের প্রথম আধ থেকে এক ঘণ্টা। এই সময়টা পেরিয়ে এলে বড় ব্যাটসম্যানেরা সাধারণত বেশ কিছুটা এগিয়ে তবেই থামেন। অনেক খুব ভালো ব্যাটসম্যান আর গ্রেট ব্যাটসম্যানের মধ্যে এই ব্যাপারটাই তফাৎ গড়ে দেয় – গ্রেট ব্যাটসম্যানেরা একবার উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়ার পর প্রতিপক্ষকে আর তেমন সুযোগ দেন না।
এই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে যদি তাদের হাফ সেঞ্চুরি আর সেঞ্চুরির অনুপাত দেখেন। ডন ব্র্যাডম্যান হাফ সেঞ্চুরির দ্বিগুন সেঞ্চুরি বা তার চেয়েও বড় ইনিংস খেলেছেন। ভি ভি এসের ক্ষেত্রে এই অনুপাত অনেকটাই বেশি। অর্থাৎ সেট হয়ে যাওয়ার পর, ডন কো পকড়না প্রায় নামুমকিন। ভিভিএসরা কিন্তু সেট হয়ে যাওয়ার পরও চান্স দেন। বা বলা ভালো অনেক ক্ষেত্রে উইকেট ছুঁড়ে চলে আসেন।
বিরাট কোহলির ক্ষেত্রে কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। তার শেষ ১৫টি ইনিংসের মধ্যে ৯ বার তিনি ৫০ বা তার বেশি বল খেলেছেন। একবার ৪৮। তবুও এই ১৫ ইনিংসে ওনার সবচেয়ে বেশি রানের ইনিংস মাত্র ৭৯ (এবং আরও দুটি ইনিংস মাত্র ৫০ পেরিয়েছে)। আই সি সির লিস্ট হিসেবে পৃথিবীর এক নাম্বার টেস্ট ব্যাটসম্যান লাবুশেনের ক্ষেত্রেও গত ১৫টি ইনিংসের মধ্যে ৫০ বলের বেশি খেলা ইনিংসের সংখ্যা ৯টি।
তবে তার মধ্যে দুটো সেঞ্চুরি, একটা ৯০ আছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন জো রুট। তারও শেষ ১৫টি ইনিংসের মধ্যে ৫০এর বেশি বল খেলা ইনিংস ৯টি। তার মধ্যেও ২টি সেঞ্চুরি এবং একটি ৮৯ রানের ইনিংস রয়েছে। তিন নাম্বার স্টিভ স্মিথেরও গত ১৬ ইনিংসে এই সংখ্যা, কি আশ্চর্য, সেই ৯। তার মধ্যে সেঞ্চুরি একটি, হাফ সেঞ্চুরি ৬টি।
নিজের উইকেটের মুল্য বোঝার ব্যাপারে বিখ্যাত ছিলেন সানি গাভাস্কার। তার খেলা শেষ ১৫টি ইনিংসেও তিনি ৫০ বা তার বেশি বল খেলেছিলেন, কি অদ্ভুত, সেই ৯বার। তার মধ্যে দুটো সেঞ্চুরি, পাঁচটা হাফ সেঞ্চুরি (তিনবার ৯০এর ঘরে)। অর্থাৎ অনেকটা ডনেরই মতো সানি একবার দাঁড়িয়ে গেলে বিপক্ষের কপালে দু:খ থাকত।
কোনো এক অদ্ভুত কারনে বিরাট উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়ার পর তার ইনিংসকে ততদুর টেনে নিয়ে যেতে পারছেন না যা একজন গ্রেট ব্যাটসম্যানের পারা উচিৎ। কারণটা শুধুই টেকনিক্যাল নাকি তার সঙ্গে মানসিক সমস্যাও রয়েছে সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। উইকেটে কিছুক্ষন কাটানোর পর কি কোনো কারণে তার মনসংযোগে চিড় ধরছে? নাকি নিজের খারাপ ফর্ম সম্বন্ধে অতিমাত্রায় সচেতন থাকায় খোলসে ঢুকে পড়ছেন? হয়ত ঠিক যখন নিজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে বোলারদের ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করার কথা সেই সময় তিনি নিজের উইকেট হারিয়ে বসছেন।
অন্যদিকে ঋষাভ পান্ত নি:সন্দেহে এই মুহূর্তে দর্শকদের চোখের মণি। পর পর দুই ইনিংসে দেখলাম নেমেই ক্রিজ ছেড়ে এগিয়ে এসে ছক্কা হাঁকাচ্ছেন। এমনিতে দেখলে মনে হয় টেকনিকে বেশ কিছু দুর্বলতা রয়েছে। শর্ট বল খেলার সময় শরীরের নড়াচড়া খুব স্বচ্ছন্দ নয়। অফ সাইডেও শটের সংখ্যা সিমিত। কিন্তু তবুও এরই মধ্যে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। সেই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় ৯৭ এবং ৮৯ রানের দুটি অমর ইনিংস। সুতরাং অনেক কিছু না থাকলেও কিছু একটা যে পন্থের আছে সেটা পরিষ্কার।
সেই ‘কিছু’র ভরসায় মাঝে মধ্যে অকল্পনীয় কিছু কাণ্ড করে বসেন ক্রিজে গিয়ে। কখনও জেমস এন্ডারসনকে এগিয়ে এসে রিভার্স ফ্লিক। কখনও এক হাতে ছক্কা (এটা বেশ কয়েকবার ঘটিয়ে ফেলেছেন)। কখনও বা পুল বা হুক খেলতে গিয়ে ক্রিজে গড়াগড়ি খাওয়া (বল যদিও সীমানার বাইরে)। একবার প্রথম বলে এগিয়ে এসে চালাতে গিয়ে ফস্কে যাওয়ার পর স্ট্যাম্প আউট হতে হতে বেঁচে গিয়ে পরের বল একই ভাবে স্টেপ আউট করে মাঠের বাইরে ফেলে দিয়ে আমাদের চোখ রগড়াতে বাধ্য করেছিলেন।
এই খেলার ধরণ দেখে অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞই বেশ ক্ষুব্ধ। কিন্তু তাদের সমালোচনায় কোন কাজ হয় বলে মনে হয় না। বরং উল্টোটা হয়ত হয়। যত সবাই ঋষভকে সাবধান করছেন, তত বেপরওয়া হচ্ছেন ঋষভ। নিজের আলো দীর্ঘস্থায়ী নয়, আরও উজ্জ্বল করার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী তিনি। তাতে যদি মোমবাতির দুই প্রান্তে আগুন জ্বালাতে হয় তাতেও তার আপত্তি নেই।
গাভাস্কার এবং ঋষাভ দুই বিপরীত মেরুর ক্রিকেট দর্শনের প্রতিনিধি। একজন প্রথম দুই ঘণ্টা বোলারদের দিয়ে বিনিময়ে দিনের বাকি অংশ দখল করতে আগ্রহী, অন্যজন ওই দুই ঘণ্টার মধ্যেই দর্শকের পয়সা উসুল করে দিতে সচেষ্ট থাকেন। একজনের কাছে ক্রিকেট জীবন, অন্যজনের কাছে বিনোদন। একজন কিছুতেই হারতে চান না, অন্যজন জয় ছাড়া অন্য কিছুর কথা চিন্তা করেন না।
আজকাল অবশ্য দুই মেরুর বিশুদ্ধ ক্রিকেটার পৃথিবীতে বিরল। বেশিরভাগেরই অবস্থান দুই মেরুর মাঝামাঝি। গ্রেস, ট্রাম্পার, মিলার, ভিভ, বোথাম, কপিল, গিলক্রিস্ট, শেবাগদের ধারার নবতম সংযোজন ঋষাভ। তবে এঁদের উচ্চতায় উঠতে তার আরও অনেকটা পথ চলা বাকি। সবার মত তারও জীবনে ব্যর্থতা আসবেই। তখন হয়ত সচেষ্ট হবেন নিজের টেকনিক মাঝাঘষা করে নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়র প্রলম্বিত করতে।
যদি সফল হন তাহলে আরও অনেকটাই উন্নত হবে তার রেকর্ড, উপকৃত হবে দলও। বা হয়ত উনি শেষ দিন অব্দি নিজের মতোই খেলে যাবেন। কখনও দায়িত্বজ্ঞানহীন ক্রিকেটের জন্যে মানুষের গালাগাল খাবেন, চাই কি দল থেকে বাদও পড়তে পারেন। কিন্তু তিনি তাতে আফসোস করবেন না। যেমন আফসোস করেন নি ভিভ বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্যাজুয়াল পুল খেলে কপিলের হাতে ধরা পড়ার পর বা পরের এডিসনের সেমি ফাইনালে কপিল নিজে হেমিংসকে স্টেডিয়ামের বাইরে নিক্ষেপ করতে গিয়ে গ্যাটিং-এর হাতে ক্যাচ দিয়ে।
কারণ দুজনেই তার আগের বিশ্বকাপেই নিজের নিজের দলকে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন করতে সবচেয়ে বড় ভুমিকা নিয়েছিলেন দুই স্মরণীয় ইনিংস খেলে। তারা এরকমই। অরন্যের প্রাচিন প্রবাদের প্রতিনিধি তারা – যে তরওয়ালের সাহায্যে তারা জীবন ধারন করেন, সেই তরওয়ালই তাদের মৃত্যুর কারণও হয়।
এটাই ক্রিকেট, এই ক্রিকেট দেখতেই আজও দর্শক মাঠে ছুটে আসেন। তারা হয়ত ফ্লিপার কাকে বলে জানেন না বা গ্রিন টপে আউট স্যুইং ছেড়ে দেওয়ার কদর বোঝেন না। কিন্তু একজন ব্রায়ান লারা যখন ব্যাট হাতে প্রতিকূল পরিবেশে বিপক্ষের শক্তিশালী বোলিং আক্রমণ হাসতে হাসতে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেন তখন তারা ঠিকই বুঝতে পারেন তার প্রতিভা এবং সৌন্দর্য্য।
এই দ্বৈতবাদ চিরকাল ধরেই চলে আসছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ক্লাস এবং মাস। আর্ট সিনেমা আর কমার্শিয়াল সিনেমা। জ্ঞানি এবং ভক্ত। মেথড এবং স্পন্টেনিয়াস অ্যাক্টিং। মেহনত এবং প্রতিভা।
দিন কয়েক আগে খেলা বাবর আজমের ১৯৬ রানের ইনিংসও নি:সন্দেহে অত্যন্ত উঁচু স্তরের। উনিও ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটা মনে রাখার মতো ইনিংস খেলে ফেলেছেন অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার শক্তিশালী বোলিংয়ে বিপক্ষে। তবে তার মধ্যে বেশ কয়েকটা সেঞ্চুরিতে পরিবর্তিত হয় নি। এই ইনিংস হয়ত তাকে ওই অভ্যেসের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে বেশ কিছুটা। তবে অনেকটা ঋষভেরই মতো, তারও অনেকটা পথ চলা এখনও বাকি। তার সেঞ্চুরির সংখ্যা এখনও মাত্র ছয়, তার মধ্যে মাত্র দুটো শক্তিশালী বোলিংয়ের বিরুদ্ধে।
শুধু বাবর বা পন্থ নন, নতুন উঠে আসা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সঙ্গে রয়েছেন লাবুশাঙ্গেও। এবং অবশ্যই আছেন স্মিথ, উইলিয়ামসন, জো রুটরা। আরও একটা নাম থাকার কথা। সেই নাম না নিলেও চলবে। তবে আর শুধু নামে বেশিদিন চলবে না। এবার তার ব্যাটকে কথা বলতে হবে। সময় আর বেশি নেই – দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।