ফিলো ফরনস্বর্থ নামক এক মার্কিন ব্যক্তি ১৯২৭ সালে সানফ্রান্সিসকো শহরে প্রথমবার দুনিয়াকে ইলেকট্রনিক টেলিভিশনের সাথে পরিচয় করান। এই ঘটনা তারও ২৫ বছর আগের। তাই দূরদর্শনে সংরক্ষিত থাকার প্রশ্ন নেই। থাকলে হয়তো সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেট ক্যাচ হিসাবে গণ্য হতো।
পয়েন্টে জন্টি রোডসের উড়ন্ত ক্যাচ যেমন হয়। বা কপিলের ’৮৩ ফাইনালের ক্যাচ। বা স্টোকসের ২০১৫ ট্রেন্ট ব্রিজের স্লিপ ক্যাচ। শোনা যায় ভদ্রলোক নাকি লং অন থেকে স্কোয়ার লেগ অব্দি দৌড়ে গিয়ে ক্যাচটি লোফেন। এবং এমন সময়ে লোফেন, যে ম্যাচের ভাগ্য পুরোপুরি বদলে যায়। একটু বিশদেই বলি তাহলে।
১৯০২ সালের এশেজ সিরিজ চলছে। ম্যানচেস্টারে চতুর্থ টেস্ট। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে এগিয়ে ১-০। তার জন্যে অবশ্য আবহাওয়ার কিঞ্চিৎ প্রশংসা প্রাপ্য। বার্মিংহ্যামে প্রথম টেস্টে উইলফ্রেড রোডসের ৭ উইকেটের সৌজন্যে অস্ট্রেলিয়া ৩৬ অল আউট হয়েও, বৃষ্টির কারণে ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয় টেস্টে তো সাকুল্যে ৩৮ ওভার খেলা হয়। তৃতীয় টেস্ট অবশ্য এই কাহিনীর নায়কের ব্যাটিং ও মন্টি নবেল ও হিউ ট্রাম্বলের বোলিংয়ের সৌজন্যে অস্ট্রেলিয়া জিতে নিয়েছে।
ম্যানচেস্টারে চতুর্থ টেস্টে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ২৮৬’র জবাবে, একসময় ৪৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা ইংল্যান্ডকে ২৬২ অব্দি পৌঁছে দিয়েছে ৬ নম্বরে নামা স্ট্যানলি জ্যাকসনের অন্যতম সেরা সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ৮৬ রানে বান্ডিল। ইংল্যান্ডকে জিততে গেলে করতে হবে ১২৪। ইংল্যান্ডের স্কোর তখন ১১৬ রানে ৮ উইকেট।
ইংরেজ উইকেট রক্ষক ডিক লিলি স্কোয়ার লেগ দিয়ে একটু তুলে মারলেন। হওয়ার গতি যেদিকে তার উল্টো দিকে। সেটা অবশ্যই ফিল্ডিং দলের খানিক সুবিধা করে দেয়। তা সত্ত্বেও ক্যাচ হবার সম্ভাবনা ছিল সিকির সিকি ভাগ। কারণ যে একজন ফিল্ডারের ক্যাচটি ধরার সুযোগ রয়েছে, তিনি তখন লং অনে। উইজডেন পরে লেখে, ‘যে ক্যাচটি নেওয়া হয়, সেটার জন্যে ঝাঁপাতেও সিংহ ভাগ ফিল্ডাররা কুন্ঠা বোধ করবে।’
কিন্তু ভদ্রলোক ক্যাচটি নেন। অস্ট্রেলিয়া যেতে। সিরিজও পকেটস্থ করে। পরের ওভাল টেস্টে যদিও গিলবার্ট জেসপের জাদু দণ্ড ইংল্যান্ডকে অভাবনীয় জয় এনে দেয়, কিন্তু রাবার ততক্ষনে ডেড। যে ভদ্রলোক ক্যাচটি নেন, তাঁর নাম ক্লেম হিল। জন্মেছিলেন ১৮ মার্চ, ১৮৭৭।
প্রাক ব্র্যাডম্যান যুগে, ট্রাম্পার এবং তিনিই ছিলেন অস্ট্রেলীয় ব্যাটিংয়ের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদ্বয়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে একটি আন্তঃ কলেজ ম্যাচ ৩৬০ রান করে হৈচৈ ফেলে দেন হিল। যেকোনো ধরণের ক্রিকেট মিলিয়ে হিলের ৩৬০ ছিল অস্ট্রেলিয়ায় তৎকালীন সর্বোচ্চ রান। ডেভ গ্রেগোরির দল যখন জেমস লিলিহোয়াইট এর দলের বিরুদ্ধে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট খেলছে, তার চতুর্থ দিনে ক্লেম হিলের জন্ম।
তখন বোধহয় হিলের ক্রিকেটার পিতা ভাবতেও পারেননি, এই ছেলে একদিন টেস্ট ক্রিকেটে এমন কয়েকটি রেকর্ড করবে, যা কোনোদিন ভাঙা সম্ভব নয়। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বার ৯৯, ৯৮, ৯৭ ও ৯৬ রানে আউট হবার রেকর্ড।
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম হাজার রান পার করার রেকর্ড। এবং যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য্যের, ৯৯, ৯৮, ৯৭ এর ইনিংসগুলি খেলা হয়েছিল একেবারে গায়ে গায়ে। ১৯০১-০২ এর এসেজে । মেলবোর্ন টেস্টে ৯৯। এবং পরের এডিলেড টেস্টে ৯৮ ও ৯৭। তবে হিলের সেরা ইনিংস এগুলোর একটাও না। সেটার কথাই বলি তবে।
ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হতে বাকি আর মাত্র বছর দুই। আন্ড্রিউ স্টোডার্ট তাঁর ইংরেজ দল নিয়ে গেছেন অস্ট্রেলিয়া। এবং সিডনিতে প্রথম টেস্ট জিতে শুরুটাও মন্দ করেননি। পরের দুটি টেস্ট অস্ট্রেলিয়া ইনিংসে জিতলেও, মেলবোর্নে চতুর্থ টেস্টের শুরু থেকেই ইংরেজরা যেন নতুন উদ্যম পেয়ে যায়। ওপেনিং বোলার দ্বয়, টম রিচার্ডসন ও হিয়ার্ন মাত্র ৫৭ রানে অস্ট্রেলিয়ার ৬ উইকেট তুলে নেন।
ডার্লিং, গ্রেগরি, নোবেল, অধিনায়ক ট্রট-সবাই ততক্ষণে প্যাভিলিয়নে। কিন্তু এরপর শুরু হলো ট্রাম্বলকে নিয়ে হিলের লড়াই। হিল করেন ১৮৮। ট্রাম্বল ৪৬। তাঁদের জুটির রান সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬৫ রান। অস্ট্রেলিয়া শেষ করে ৩২৩ রানে। হিল ফার্স্ট ডাউন নামেন। আউট হন নবম উইকেটের পতনে। ক্রিকইনফো লিখছে, ‘এই ম্যাচে হিলের ব্যাটিং এ মৌসুমে ইংরেজদের কলোনি সফরের সেরা।’
হিল যে কখন ইংল্যান্ডের কাছে এভারেস্ট সম পর্বত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন ! ইংল্যান্ড আর ম্যাচে ফিরতে পারলো না। ৮ উইকেটে হেরে সিরিজ জলাঞ্জলি দিলো। এই পর্বত প্রমাণ ইনিংসের ভিত কিন্তু শুধু হিলের চমকপ্রদ স্ট্রোকপ্লে নয়। তাঁর পাহাড়ের মতন ব্যাটিং ধৈর্য্যও বটে। হিলের আরেকটি সেরা ইনিংসের কথা বলে শেষ করি। এই ১৮৮র বছর আষ্টেক পরের কথা। হিল তখন ৩১। আবারও ইংল্যান্ড।
তবে এবার ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হিল তাঁর প্রিয় জায়গা তিন নম্বরে নামার সুযোগ পাননি। প্রথম ইনিংসে আসেন ৭ নম্বরে এবং করেন মাত্র ৫। দ্বিতীয় ইনিংসে শরীর আরও খারাপ। এবার নামলেন ৯ নম্বরে। অস্ট্রেলিয়া তখন ১৮০ রানে ৭ উইকেট। আদতে ১০২ রানে ৭ উইকেট। এর সাথে জুড়ে দিন অ্যাডিলেডের অসহ্য গরম।
কিন্তু, ৮ নম্বরে নামা হারটিগানের সাথে জুড়ি বেঁধে অস্ট্রেলিয়াকে ইংল্যান্ডের ঝোড়ো বোলিং এর বিরুদ্ধে বিপদসংকুল টালির চালের ঘর থেকে পৌঁছে দেন ৫০১ রানের নিরাপদ পাকা আশ্রয়ে। হিল করেন ১৬০। হারটিগান ১১৬। টেস্ট ক্রিকেটে ৮ এবং ৯ নম্বর ব্যাট দুজনেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন মাত্র দুবার। হিল-হারটিগানের কীর্তির ১০৯ বছর পর ডোরিচ ও হোল্ডার এই কীর্তির যুগ্ম মালিক হন।
এমনিতে খোশমেজাজি হলেও, একবার একটি ঘটনা ঘটান ক্লেম হিল, যা না বললে কাহিনী শেষ হবে না। ১৯১২ সালে হিল তখন অধিনায়ক। সাথে আবার নির্বাচকও। তা পিটার ম্যাকলিস্টার নামের আর এক নির্বাচকের সাথে হিলের প্রায় মিনিট কুড়ি এমন হাতাহাতি হয়, যে নির্বাচক কমিটির মিটিং কিছুক্ষন বন্ধ রাখতে হয়। ম্যাকলিস্টার বছর তিনেক আগে যখন খেলোয়াড় ছিলেন, তখন থেকেই হিলের সাথে তাঁর ঠোকাঠুকি।
তৎকালীন বহু খেলোয়াড়ও ম্যাকলিস্টারকে বোর্ডের গুপ্তচরের বদনামও দিয়েছেন। কুকারে হিল এবং ম্যাকলিস্টারের সম্পর্ক চাপে সিদ্ধ তো হচ্ছিলোই। নির্বাচনী মিটিংয়ে কুকারের সিটি আওয়াজ করা শুরু করে। কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি অব্দি ব্যাপারটা পৌঁছয়। এবং হিলকে হোটেলে ফেরত পাঠিয়ে বাকি মিটিং শেষ করতে হয়। ‘হিল’ ও যে কখন চাপে চাপে ভলকানো হয়ে যেতে পারে, সেটা বোধহয় বোঝা যায়না। তবে ক্লেম হিলকে মনে রাখার আরও অনেক বড়ো কারণ হলো, তাঁর ক্রিকেটীয় কীর্তির অনতিক্রম্য পাহাড়। সেটা হিল নয়। একেবারে খাস মাউন্টেন।