বাংলাদেশ দলে সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজন নিয়ে আলাপটা লম্বা সময় ধরেই চলছে। অনেকের মতে এটি মিডিয়ার সৃষ্টি। কারো কারো মতে সিনিয়র ক্রিকেটারদের নির্দিষ্ট সমর্থকদের কারণেই এমন বিভাজন। যদিও সিনিয়র ক্রিকেটাররা এসব মানতে নারাজ।
এক সাক্ষাৎকারে একবার সাকিব বলেছিলেন তিনি সিনিয়র-জুনিয়র তত্ত্ব মানেন না। তাঁর কাছে দলের এগারো জনই সমান। সাকিবের কথায় আমরাও একমত। সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজন কেন হবে? সবাই জাতীয় দলের ক্রিকেটার। দলের জন্য সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত নয়কি?
অবশ্য এর মূলে ছিলো জুনিয়রদের ধারাবাহিক ব্যর্থতা। কারণ সিনিয়রদের পারফরম্যান্সই বেশিরভাগ ম্যাচে বাংলাদেশকে জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে খেলা কিংবা ধারাবাহিক পারফরম্যান্সটা ঠিক দেখাতে পারছিলেন না লিটন-মিরাজরা। সৌম্য সরকার, লিটন দাস, মেহেদি মিরাজরা প্রতিভাবান কিংবা সামর্থ্য থাকলেও ধারাবাহিক পারফরম করতে ব্যর্থ ছিলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যত নিয়েও ছিলো সংশয়! সিনিয়রদের অবসরের পর কি সেই পুরনো বাংলাদেশকেই আবার দেখা যাবে?
জুনিয়রদের দিকে সমালোচনার তীরটা ছিলো বরাবরই। সিনিয়ররা ব্যর্থ হলে দলের হাল ধরার জন্য ভরসা করার মতো ছিলেন না কেউ। জুনিয়রদের মধ্যে ধারাবাহিকতা না থাকাতেই মূলত এতো আলোচনা-সমালোচনা।
অবশেষে আলোচনাটাকে এখন মনে হচ্ছে, আর দরকার নেই।
সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজন কিংবা এই অপ্রয়োজনীয় তত্ত্বের অবসানটা হয়তো ঘটতে যাচ্ছে। সবশেষ বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো বড় জয়েই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে তরুণ ক্রিকেটাররা। গেলো এক বছরে বাংলাদেশের জয় পাওয়া ম্যাচগুলো মেহেদি হাসান মিরাজ, আফিফ হোসেন, তাসকিনা আহমেদ, নাসুম আহমেদদের অবদান স্পষ্ট।
এইতো সবশেষ নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্টে মাউন্ট মঙ্গানুইতে এক ঐতিহাসিক জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। বিরুদ্ধ কন্ডিশন, বাউন্সি উইকেট, নিউজিল্যান্ডের পেসারদের গতি-স্যুইং-বাউন্স – এমন অবস্থা থেকেও দাপুটে এক জয়। এই জয়ের পেছনের নায়কটা পেসার এবাদত হোসেইন। যার দলে থাকা নিয়েই ছিলো সমালোচনা, সেই এবাদতই কিনা নিউজিল্যান্ড বধের নায়ক! টেস্ট ক্যারিয়ারে টানা ব্যর্থতা আর হতশ্রী পরিসংখ্যানের পর এবাদতের উপরই বা আস্থা রেখেছিলেন ক’জন?
আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ২১৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে এক লজ্জাজনক পরাজয়ের সামনে বাংলাদেশ! ঘরের মাটিতে আফগানদের বিপক্ষে এমন অসহায় আত্মসমর্পণ মেনে নেওয়া যায়? ওই ম্যাচে দলের জন্য ত্রানকর্তা হিসেবে আসেন আফিফ-মিরাজ।
দু’জনের রেকর্ডগড়া জুটিতে খাদের কিনারা থেকে উঠে এসে আফগানদের হারিয়ে দুর্দান্ত এক জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ! নিশ্চয়ই কেউ ভাবতে পারেনি ওই ম্যাচে জয় পাবে বাংলাদেশ? সত্যি বলতে আফিফ-মিরাজদের উপর এতোটা ভরসা দেখানোর সাহস কেউই করেননি। কিন্তু তাঁরা সেটি ঠিক করে দেখিয়েছে। ওই সিরিজে লিটন দাসের অনবদ্য পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে সিরিজ জয়ের ভিত গড়ে দেয়।
এরপর সেখান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর ! এর আগে কখনোই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে জয়ের দেখা নেই। ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা বলতে গেলে অপ্রতিরোধ্যই। এইতো সবশেষ সিরিজে প্রোটিয়াদের কাছে পাত্তাই পায়নি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ভারত। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভালো খেলাটাই যেনো ছিলো বাংলাদেশের জন্য বড় প্রাপ্তি। আর একটা ম্যাচ জিতে গেলে তো বিশাল ব্যাপার।
সবার প্রত্যাশা ছাপিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ইতিহাস গড়লো মিরাজ-তাসকিনরা! নিউজিল্যান্ডের পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও এক ঐতিহাসিক জয়ের দেখা পেলো বাংলাদেশ। প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ম্যাচ জয়, প্রথমবার সিরিজ জয়ের স্বাদ! এ যেনো অবিশ্বাস্য! রূপকথার গল্পকেও হার মানানোর মতো ব্যাপার। অগ্নিঝরা বোলিংয়ে ম্যাচ সেরা ও সিরিজ সেরা তাসকিন আহমেদ! মেহেদি মিরাজ, লিটন দাস, আফিফ হোসেনরা এবারও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
এর আগে ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে ধরাশায়ী করার পেছনের নায়ক ছিলেন স্পিনার নাসুম আহমেদ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজেও ছিলেন দুর্দান্ত। এছাড়া মুস্তাফিজও এখন দেশের অন্যতম সেরা তারকা!
সিনিয়রদের ছাপিয়ে গেলো কয়েক সিরিজেই সেরা পারফরমার জুনিয়র ক্রিকেটাররা। কিন্তু তাসকিন, লিটনদের জুনিয়র বলাটাই বা কতটুক যৌক্তিক? ৬-৭ বছর ধরে ক্রিকেট খেলার পর নিশ্চয়ই জুনিয়র কোটার গন্ডিটা পেরিয়ে গেছেন তাসকিন-লিটনরা? কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই সিনিয়র-জুনিয়র তত্ত্বের কারণেই সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ বাদে বাকিরা পড়ে থাকেন জুনিয়রদের তালিকায়!
এই সিনিয়র-জুনিয়র তত্ত্ব মানতে নারাজ হেড কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো। তিনিও বলেছেন তাঁর কাছে সবাই সমান। সিনিয়রদের আলাদাভাবে দেখার মানে হয় না। সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গুটিকয়েক মিডিয়া আর সমর্থকদের একাংশের সমালোচনার সামনে ডোমিঙ্গোর টিকে থাকাটাই তো বড় দায়! খোদ সাকিব-তামিমরাই জুনিয়রদের পারফরম করতে দেখতে চান, তাঁদেরকেও দিতে চান সমান গুরুত্ব।
সিনিয়ররা গেলে দলের কি হবে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যত কি? এসবের জবাবটা মাঠেই দিচ্ছেন আফিফ, মিরাজ, লিটন, তাসকিনরা। সমালোচনার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সূর্যদয়ের দেখে মিলেছে লিটন-তাসকিনদের। বছর খানেক আগেও যেখানে সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদদের পিঠে চড়েই চলছিলো বাংলাদেশের ক্রিকেট। বছর ঘুরতেই পালটে গেলো সব! তথকথিত পাণ্ডবদের ছাপিয়ে এখন লাইমলাইটে আফিফ-মিরাজ-তাসকিনরা।
এই লিটন, তাসকিন ও বাকি তরুন ক্রিকেটারদের হাত ধরেই হয়তো অবসান হতে চলেছে সিনিয়র-জুনিয়র তত্ত্বের। তরুনদের হাত ধরে এগিয়ে যাবে এদেশের ক্রিকেট। লিটন-তাসকিনের রাজকীয় প্রত্যাবর্তন, আফিফ-মিরাজদের দায়িত্বশীল পারফরম্যান্সে সমর্থকদের আস্থার জায়গাও এখন তাদের উপর! এদের মধ্যে ম্যাচুরিটি, ম্যাচ জয়ের ক্ষুদা, অদম্য চেষ্টা সবই আছে। আপাতত বলতে চাই নিরাপদ হাতেই আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যত!