২০১১ সাল।
টিফিন ব্রেকের সময় স্কুলের মাঠে বন্ধুরা মিলে গোল্লাছুট খেলছিলাম। বাসায় দুপুরের খাবার সেরে এক বন্ধু এসে আক্ষেপ নিয়ে বলছিলো যে বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জহুরুল ইসলাম অমির জায়গা হলো না। আসলে সে রাজশাহীর,অমিও রাজশাহীর তাই আর কি ব্যাপারটা মেনে নিতে একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছিলো তার। জহুরুল ইসলাম অমি তখন খেলোয়াড় হিসেবে তেমন পরিচিত ছিলেন না।
তাই এমন একজন খেলোয়াড় বিশ্বকাপের চূড়ান্ত স্কোয়াডে জায়গা না পাওয়ায় সেই বন্ধুর আক্ষেপ দেখে আমাদের মধ্যে অনেকেই হাসাহাসি করেছিলো সেদিন। কিন্তু পরক্ষণে তাদের হাসিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কারণ তাদের জন্য এমন একটি খবর অপেক্ষা করছিলো যা শুনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।
খবরটি শুনে সবারই হজম করতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো। সেদিন বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্কোয়াডে এমন একজনের জায়গা হয় নি যা মেনে পারেনি আমাদের কেউই। সম্ভবত মেনে নিতে পারেনি পুরো বাংলাদেশ। কারণ ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের মত আসরে জাতীয় দলের স্কোয়াডে যে সেদিন ঠাঁই মেলেনি দেশসেরা পেসার মাশরাফি বিন মুর্তজার।
মাশরাফি যে বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশ দলে থাকছেন না তা দল ঘোষণার আগেই অবশ্য গণমাধ্যমের কল্যাণে কিছুটা আচ করা যাচ্ছিলো। তারপর ২০১১ সালের আজকের এই দিনে সেটি নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ দলের তৎকালিন প্রধান নির্বাচক রফিকুল আলম। ফিটনেসের অভাবে দল থেকে বাদ পড়েন মাশরাফি।
মূলত সেবার প্রিমিয়ার লিগে খেলার সময় পাওয়া হাঁটুর চোট ভেঙে দিয়েছিল ঘরের মাঠে মাশরাফির বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। অথচ বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল এই মাশরাফির। আরেকটিবার নিয়তির নিষ্ঠুরতার শিকার হলেন তিনি। নিয়তির সাথে যেন তাঁর দাঁ-কুমড়া সম্পর্ক। নিয়তির মারপ্যাঁচেই মূলত বিশ্বকাপ খেলার আশা খোয়াতে হয় মাশরাফিকে। তা না হলে কেন বিশ্বকাপের আগেই তাকে ইনজুরির শিকার হতে হবে!
বিপত্তিটা ঘটে ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর। বিকেএসপিতে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে আবাহনীর হয়ে খেলছিলেন মাশরাফি। ব্যাট হাতে মোকাবেলা করা নিজের প্রথম বলে একটি দ্রুত রান নেয়ার প্রচেষ্টা মাশরাফির। কিন্তু পিচের অন্য প্রান্ত থেকে ফরহাদ হোসেন ঝুঁকিতে সে রানটি নিতে চান নি। মাশরাফি ঘুরে নিজের অবস্থানে ফিরে যেতে চেষ্টা করলেন। পড়ে গেলে পিচে এবং সঙ্গে সঙ্গে রান আউট। ওই ম্যাচে ডান হাঁটুতে প্রবল চোট পায় মাশরাফি যা পরবর্তীতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বকাপে তাঁর খেলার সামনে।
মাশরাফি বিন মুর্তজা বরাবরই আমুদে। হই- হুল্লোর, আনন্দ-ফুর্তিতে জীবনটা উপভোগ করাই তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু তাঁর আনন্দের রেলগাড়িটা থেমে যায় ২০১১ সালের বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ এলে। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও তাঁর মনে বেজে উঠে বিষন্নতার হুইসেল। দল ঘোষণার ওইদিনেও মাশরাফি অ্যাকাডেমি মাঠের নেটে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন বিশ্বকাপের জন্য। কিন্তু হায়! যে বিশ্বকাপের জন্য এত প্রস্তুতি সেই বিশ্বকাপের দলে সুযোগই পেলেন না তিনি।
মাশরাফি জীবনে অনেকবার ইনজুরির শিকার হয়েছেন। মিস করেছেন দেশের হয়ে অনেক ম্যাচ। কখনোই তাকে হতাশ হতে দেখা যায়নি। বরং ইনজুরির বাঁধাকে দূরে ঠেলে নতুন উদ্যমে দলে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করার নামই ছিল মাশরাফি। কিন্তু, প্রিমিয়ার লিগে পাওয়া ওই চোটে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন ভেঙে গেলে প্রথমবারের মত মাশরাফিকে দেখা যায় ভেঙে পড়তে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করার পরও যথেষ্ট ফিটনেসের অভাবে বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাননি তিনি।
পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে প্রতিপক্ষের পাশাপাশি ভাগ্যের বিপক্ষেও লড়তে হয়েছে মাশরাফিকে। বুক চিতিয়ে প্রতিটি লড়াইয়ের পর জয়ের বেশেই ফিরতে দেখা গেছে তাকে। কিন্তু ওই একটি লড়াইয়ে ভাগ্যের কাছে হার মানতে হয় মাশরাফিকে। দল ঘোষণার পর পরই দলে জায়গা না পাওয়ার খবরটা পৌঁছে যায় মাশরাফির কানে।
তবে এ বিষয়ে আগেভাগে কিছু জানতেন না তিনি। বিশ্বাস ছিল দলে জায়গা হবে। তাই এমন খবর শোনার জন্য সেদিন প্রস্তুত ছিলেন না মাশরাফি। সকল বাধা বিপত্তিতেও অবিচল মাশরাফি সেদিন ভেঙ্গে পড়েছিলেন। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি তিনি। কান্নায় ভেঙে পড়েন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’।
তাঁর চোখের জলে সেদিন সিক্ত হয়েছিল অ্যাকাডেমি মাঠের সবুজ ঘাসগুলো। সামনে আরো অনেক বিশ্বকাপ পড়ে রয়েছে বলে নিজেই নিজেকে দিয়েছিলেন সান্ত্বনা। নিজেই নিজেকে দেয়া নিছক সান্ত্বনার সেই দিনটার কথা মনে পড়লে আজও আতকে ওঠেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।
সময় আসলে থেমে থাকে না। সময় ছুটে চলে তার আপন গতিতে। নদীর স্রোতের মতই সেদিনের পর ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুছে গেল সাতটি বছর। সময় মাশরাফির দু:খে প্রলেপ দিতে পারেনি, হয়ত আর পারবেও না। মাশরাফি ২০১১ বিশ্বকাপ মিস করার পর আরো দু’টি বিশ্বকাপ খেলেছেন।
সফলতার সাথে দলকে নেতৃত্বও দিয়েছেন। বিশ্বকাপের মঞ্চে নিশ্চিত ভাবেই দেশের সেরা অধিনায়ক। কিন্তু এই বিশ্বকাপও মাশরাফির দু:খে প্রলেপ দিতে পারেনি, আর কোন বিশ্বকাপ পারবেও না। কারণ তিনি নিজেই অনেকবার জানিয়ে দিয়েছেন আগামী ৫০ টা বিশ্বকাপ খেললেও ওই দু:খ ঘুচবে না তাঁর।
২০১১ বিশ্বকাপের জন্য দল ঘোষণার পর মাশরাফি ছাড়া দলকে অপূর্ণ বলেছিলেন তখনকার অধিনায়ক সাকিব আল হাসান; যেন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের কথাই সেদিন ভেসে উঠেছিল সাকিব আল হাসানের কণ্ঠে।
এর তিন বছর বাদে দেশের মাটিতে আবারও বিশ্বকাপের আসর বসে। এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। মিরপুর শেরে বাংলায় নিজেদের প্রথম ম্যাচে এবার ম্যাচের প্রথম বলেই ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ আঘাত হানেন। ফিরিয়ে দেন আফগানিস্তানের মোহাম্মদ শাহজাদকে। কে জানে, সেদিনও ২০১১’র দু:স্বপ্ন ভুলতে পেরেছিলেন কি না তিনি!