হাসতে হাসতে বিশ্বজয়

ফ্রান্স অধিনায়ক হুগো লোরিস গোল-কিক নেয়ার জন্য বল বসানোর আগেই টাচ লাইনে কিছুটা চঞ্চলতা কারো চোখ এড়ালো না। ইলেক্ট্রনিক বোর্ড উঁচিয়ে ধরেছেন চতুর্থ রেফারি, তার মানে মাঠের ২২ জনের মধ্যে কোন একজনের উঠে পড়ার ঘোষণা আসছে। লাল হরফে ‘১৩’ সংখ্যাটা ভেসে উঠলো।

গাঢ় নীল জার্সি গায়ে ছোটখাটো একটা মানুষ যার মুখের অভিব্যক্তি তখন পড়া যাচ্ছিল না, কিন্তু শরীরী ভাষায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট। ৯০ মিনিট পর্যন্ত সমানতালে মাঠে দাঁপিয়ে বেড়ানোর সক্ষমতা যার রয়েছে – সেই খেলোয়াড়টাই যেন মাত্র বড্ড হাঁপিয়ে গেছেন। মাঠে থাকা ৫৫ মিনিটের পুরোটা নিজেকে যেন হারিয়ে খুঁজেছিলেন সেদিন।

বদলি হিসেবে স্টিভেন এন’জঞ্জি মাঠে ঢুকেছিলেন আর অন্যদিকে দুর্বল তালিতে ৭৮ হাজার দর্শকের অভিবাদনের জবাব দিলেন ‘১৩’ নম্বর জার্সি পরা খেলোয়াড়টি। মাঠ থেকে বেরোনোর সময় তার মনের কথা হয়তো জানা যায় না, তবে ধারনা নিশ্চয়ই করা যায়; শরীরের অভিব্যক্তিতে তীব্র হতাশা ফুটে উঠেছিল সে সময়।

জীবনের সবচেয়ে বড় ম্যাচে যে বড্ড নিষ্প্রান ছিলেন এই ফ্রান্স ফুটবলার। ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচেই ম্যাড়ম্যাড়ে এক পারফরম্যান্স এসেছিল তার কাছ থেকে। হ্যাঁ,  হয়তো বুঝে ফেলেছেন; কথা হচ্ছে এনগোলো কান্তে-কে নিয়ে। এমন এক ম্যাচে ছাপ ফেলতে না পারার আফসোস নিয়ে সেদিন সাইডবেঞ্চে ফিরে এসেছিলেন তিনি।

তবু এনগোলো কান্তে’র বিশ্বকাপ মেডেল নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। পুরো বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট জুড়েই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছিলেন এনগোলো। ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন যে কয়জনের নাম মনে পড়বে তাদের একজন নিশ্চয়ই হবে এন’গোলো কান্তে; হতেই হবে।

কান্তে পরিবার আশির দশকে ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমিয়েছিলেন ফ্রান্সে। ১৯৯১ সালের ২৯ মার্চ এই দম্পতির ঘরে এসেছিল এক ছেলে; বাবা-মা এক প্রাচীন রাজার নামে তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘এনগোলো’। কিন্তু তার থাকার জায়গাটা কোনোভাবেই প্রাসাদ ছিল, প্যারিসের উপকন্ঠে ওদের বাসাটার দেয়ালে কান পাতলে কেবলই শোনা যেত অভাবের দীর্ঘশ্বাস।

এনগোলো একে একে আরো পাঁচ-পাঁচটা ভাইবোন পেয়েছিলেন, পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছিল অভাব। নিষ্ঠুর দুনিয়ায় পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে পাবার আগেই জন্মদাতা বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে মায়ের টিকে থাকা লড়াইয়ে একমাত্র সঙ্গী হতে বাধ্য হলো কান্তে।

সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ করে তবে দুমঠো খাবার জোগাড় করতে হতো কান্তে-কে। তবে কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই গোপন অভিসারে নেমে পড়তেন এনগোলো। অভিসারটা ছিল ফুটবলের সাথে; মাঠ, ছেঁড়াফাটা একটা বল, আর দুই একজন সঙ্গী পেলেই ফুটবলের সাথে তার প্রেম শুরু হয়ে যেত।

ফুটবল খেলাটা হয়তো নিতান্তই শখের বশে খেলতেন কান্তে তবে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ চারপাশটা বদলে দিল। বিশ্বকাপ জিতেছিল ফ্রান্স যার নায়ক ছিলেন জিনেদিন জিদান নামক এক আফ্রিকান অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান। কান্তেও হয়তো সেদিন থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন; স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন তিনিও মাথার উপরে তুলে ধরবেন সোনালী ট্রফিটা, প্যারিসের সব প্রান্তে কান পাতলেই শোনা যাবে তাঁর নাম। সেই বিশ্বকাপেই মাঠের বাইরে পরিত্যক্ত বিয়ারের বোতল খুঁজে ফেরা ছেলেটা স্বপ্ন দেখলো ফুটবলের।

স্বপ্ন পূরণের শুরুটা ফ্রান্সের দ্বিতীয় বিভাগের দল বোলোনের হয়ে। ২০১২ সালের ১৮ মেতে প্রথমবারের মতো পেশাদার ফুটবলে মাঠে নামলেন এনগোলো কান্তে। এরপর ‘কায়ে’ ক্লাবের হয়ে খেলার মাধ্যমে প্রথমবারের মত ইউরোপীয় জায়ান্ট ক্লাবগুলোর নজরে পড়েছিলেন কান্তে। ডাক আসতেও দেরী হয়নি ৷ ইংলিশ মুলুকে খেলার জন্য তাকে ডেকে নিলো লেস্টার সিটি। আট মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে চব্বিশ বছর বয়সী কান্তেকে দলে ভেড়ালো ক্লদিও রানিয়েরির দল।

তবে জেমি ভার্ডি, রিয়াদ মাহরেজদের মতো লুকোনো রত্নদের যিনি খুঁজে বার করেছেন সেই স্টিভ ওয়ালশই মূলত কান্তেকে স্কাউট করেছিলেন। এরপরের গল্পটা সবারই জানা। সম্ভাব্যতার অংক কষা ফুটবল বিশারদদের ভুল প্রমান করে ১১১ বছর বয়সী লেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব নিজেদের ইতিহাসে প্রথম ইংলিশ লিগ শিরোপা জিতে নিলো। আর জয়ের অন্যতম কারিগর এন’গোলো কান্তে জিতে নিয়েছিলেন সেরা মিডফিল্ডারের পুরষ্কার।

সেই বছর আরেকটি বিশেষ মুহূর্ত এসেছিল। ১৮ই মার্চে আমস্টারডাম অ্যারেনাতে পয়লাবার ফ্রান্সের জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন কান্তে। এরপর ২০১৬ সালে ৩২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে চেলসিতে এসেছিলেন। আরেকবার লীগ জেতা, দলের মিডফিল্ডের প্রাণভোমরা হয়ে ওঠা, এফএ কাপ জয়, ইউরোপা লিগ জয় – জীবনটা খুব দ্রুতই বদলে গিয়েছিল কান্তে’র।

এরপর ২০২১ মৌসুমে মহাকাব্যিক এক যাত্রায় বহু আকাঙ্ক্ষিত চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জেতা হয়েছে এন’গোলো কান্তে’র। সে টুর্নামেন্টেও সেরা মিডফিল্ডারের পুরুষ্কার নিজের করে নিয়েছিলেন কান্তে।

সদাহাস্যজ্বল এই ফুটবলার হাসতে হাসতেই প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়েছেন কতশত বার। কতশত বার একটা পাসেই ভেঙ্গে দিয়েছেন তিল তিল করে গড়ে তোলা প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যূহ। কখনো বা ডিফেন্স লাইনে নেমে এসে থামিয়ে দিয়েছেন বিপক্ষের শক্তিশালী আক্রমণকে।

গোল করার চেয়ে গোল করানোতে সবসময় বেশি আনন্দ খুঁজে পান এই মিডফিল্ডার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সুদূরপ্রসারী চিন্তা শক্তির কারনে যেকোনো দলের বিপক্ষে সহজেই মধ্যমাঠ নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম কান্তে আর তাই যেকোনো কোচ-ই ভরসা করেন এই ফুটবলারের উপর।

রোনালদো কিংবা মেসির মত সুপারস্টার হয়তো হতে পারেননি এনগোলো কান্তে তবে এ যুগের ফুটবলের আদর্শ হওয়া উচিত এই ক্ষুদ্রাকৃতির কান্তে। এতো সাফল্য, অর্থকড়ির মাঝেও ছোটবেলার শিক্ষা ভোলেননি কখনো। এখনো ভীষণ লাজুক, মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারেন না, জৌলুস প্রদর্শনে নেই বিন্দুমাত্র আগ্রহ। ঠোঁট জোড়ায় আঠার মতো লেগে থাকে হাসি। ভালোবাসার ফুটবলকে কলঙ্ক থেকে রক্ষা করতে এমন চরিত্রেরই দরকার হয় মাঠে অথবা মাঠের বাইরে।

প্যারিসের বস্তির গলি থেকে বিশ্ব ফুটবলের বিখ্যাত সব স্টেডিয়াম; এন’গোলো দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন সমান তালে। বলা যায়, মাঝমাঠে তিনজন মিডফিল্ডার যা করতেন তা নাকি একাই করতে সক্ষম একজন এন’গোলো কান্তে। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটানা দৌড়ে বেড়াতে পারেন তিনি। তার দম দেখে যে-কেউ ভাবতে বাধ্য হয় একজনের দখলে তিনটি ফুসফুস থাকতে পারে কি না?

ক্যারিয়ারে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, বিশ্বকাপ সহ জিতেছেন সম্ভাব্য সবকিছু; চেলসি-ফ্রান্স সমর্থক তো বটেই, পেয়েছেন ফুটবলের প্রতিটা ভক্তের ভালোবাসা। ফ্রান্সের স্টেডিয়ামের বাইরে বোতল কুড়োনোর জীবন থেকে বর্তমান ফ্রান্সের নায়ক, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মিডফিল্ডার হয়ে ওঠা— এক উদ্বাস্তু অসহায় ছেলের এমন একটা রূপকথা লেখা হয়ে গেল, যা কোটি কোটি ফুটবল অনুরাগীদের নিজের স্বপ্ন ছোঁয়ার রসদ জুগিয়ে যায় বটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link