মাত্র ১২ বছর বয়সে বড় বোনকে হারান। চাচা ইয়ান হিলিকে অনুসরণ করে খেলতে চেয়েছিলেন টেস্ট ক্রিকেট। ফিনিশার হিসেবেই দলের দায়িত্বে ছিলেন। সেখান থেকে কোচের পরামর্শে উঠে আসেন ওপেনিংয়ে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি অ্যালিসা হিলিকে। ব্যাট হাতে রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে বনে গেছেন বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক।
১২ বছর বয়সী হিলি স্কুল থেকে ফিরে টেলিভিশন দেখছিলেন। হিলির মা এসে বললো তিনি হিলির বড় বোন কারিনের ফুটি (অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবল) খেলা দেখতে যাচ্ছেন। কারিন হিলির চেয়ে চার বছরের বড়। সাধারণত মা খেলা দেখতে না গেলেও সেদিন হঠাৎ ইচ্ছে হলো মেয়ের খেলা দেখবেন।
মা চলে যাওয়ার পর একাই সময় পার করছিলেন হিলি। কিন্তু কিছু সময় পর হিলির বান্ধুবির মা এসে হিলিকে জানায় তার মায়ের বাড়ি ফিরতে দেরী হবে। হিলির মায়ের কথা মতো হিলিকে নিয়ে যান তিনি। প্রথমবার বাড়ির বাইরে বান্ধুবির বাড়িতে একা রাত কাটায় সে। হিলি সেই স্মৃতি মনে করে বলেন, ‘সেটা ছিল আমার জন্য সেরা এক রাত।’
পরদিন হিলির মা বাড়ি ফিরে বলেন, ‘কারিন খেলার সময় আঘাত পেয়েছে, তাঁকে হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে! তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব বেশি ভাল নয়।’
হিলি নিজেক বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন। শুধু মনে মনে প্রার্থনা করছিলেন যাতে বোন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। তবে মায়ের ফ্যাকাশে চেহারায় হিলি যেন অন্য কিছু দেখতে পেলো। পরমূহুর্তে জানতে পারলো বোন কারিন এখন কোমায় আছে!
এর ক’দিন বাদেই খেলতে নেমে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করেন হিলি। সেঞ্চুরি করার পর হিলি দেখলো মাঠের পাশেই তাঁর বাবা অপেক্ষা করছেন। বাবা হিলিকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, ‘কারিনের লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নিয়েছে। সে আর বেঁচে নেই। তুমি চাইলে শেষবারের মত তোমার বোনকে দেখতে পারো।’
হিলির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সেঞ্চুরির আনন্দটা নিমিষেই রূপ নিলো কষ্টে। বোনার অকাল বিদায়টা মেনে নিতে পারেননি হিলি। অবশ্য ধীরে ধীরে সেই শোক কাটিয়ে পূর্ণ শক্তিতে আবারও তিনি মাঠে ফিরেন। নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়!
সবশেষ নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংলিশ অফ স্পিনারের লেগ স্টাম্পের উপর করা বলটা অফ সাইডে ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে দুর্দান্ত এক শটে বাউন্ডারি ছাড়া করলেন। যে শটটার জন্য সেরা মানা হতো পাকিস্তানের সেলিম মালিককে। ২০ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার রান ছিল ৯২। কিন্তু এই শটের পর মিডল ওভারের ব্যাটিং দাপটেই যেন বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল হিলি। বাকি সময়টা ইংলিশ বোলারদের উপর চালিয়েছিলেন তাণ্ডব।
গেল বিশ্বকাপের পর অস্ট্রেলিয়ান কোচ ম্যাথু মট হিলিকে বললেন ফিনিশার না হয়ে ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করতে। লেগ সাইডেই তখন বেশি খেলার চেষ্টা করতেন হিলি। এরপর স্বামী অস্ট্রেলিয়ান তারকা পেসার মিশেল স্টার্কের এক বন্ধু অ্যাশ স্কোয়ারের সাথে দেখা করেন হিলি। যিনি পরবর্তীতে লম্বা সময় হিলির সাথে সুইপ শট নিয়ে কাজ করেন।
গেল বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক ম্যাচে ফ্লিক করতে গিয়ে লেগ বিফোর আউট হন হিলি। লেগ সাইডে হিলির জন্য ইংলিশ অধিনায়ক এমনভাবে ফিল্ডিং সেট করলেন যাতে করে হিলি বাউন্ডারি না আদায় করতে পারে। ঠিক ভিন্ন চিত্র ছিল এবারের বিশ্বকাপে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনালে অফ সাইডে ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে বেশ কয়েকটি বাউন্ডারি মারেন এই অজি ওপেনার। লেগ স্টাম্পের বলকে অনায়াসে অফ সাইডে বাউন্ডারি ছাড়া করেন হিলি।
১৭ বছর বয়সে বেকারস কলেজের প্রথম ইলেভেনে সুযোগ পান অ্যালিসা হিলি। একমাত্র মেয়ে হিসেবে ছেলেদের ওই টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পান তিনি! পরদিন সকাল ৬ টায় চ্যানেল নাইনের এক রিপোর্টার এসে হাজির হিলির বাড়িতে। বাবা-মা বাইরে থাকায় তখন দাদির কাছে ছিলেন হিলি। রিপোর্টার একটি সংবাদপত্র দেখিয়ে বললেন এই খবর সে দেখেছে কিনা!
হিলি যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সংবাদপত্রের পাতায় বিতর্কিত এক ছবি! মূলত গুটিকয়েক ছেলেই হিলির এই টুর্নামেন্টে খেলার খবর মিডিয়ার কাছে পৌঁছে দেয়। ছেলেদের দলে কেন একজন মেয়েকে নেওয়া হবে?!
সেদিন স্কুল গেইটে মিডিয়াকর্মীদের ভীড়। ভীড় ঠেকেই কোনোরকমের স্কুলে পৌঁছায় হিলি। ‘ আমি কখনোই সেভাবে নিজেকে আলাদা ভাবে দেখিনি। কেনো ছেলেদের দলে খেলতে পারবো না। আমি অনেক বারই খেলেছি ছেলেদের সাথে। সমাজে তখন অনেকেই মনে করতো মেয়েরা খেলতে পারবে না। তবে ওই বিতর্কিত ছবির জন্য অনেক চাপ সৃষ্টি হয় আমার উপর। ‘
বয়স ৯ থেকে ১৫ বছর – ছয় বছর অস্ট্রেলিয়ার তারকা পেসার মিশেল স্টার্কের সাথে খেলেছিলেন হিলি। ওই সময় অবশ্য স্টার্ক একজন উইকেটরক্ষক হিসেবে খেলতেন। তখন হিলি ও স্টার্ক বেশ ভাল বন্ধু ছিলেন। হ্যাঁ, স্রেফ বন্ধুই। সেই স্মৃতি মনে করে হিলি বলেন, ‘ স্টার্কের সেসময়ের কথা খুব বেশি কিছু মনে করতে পারছিনা। সে খুব শান্ত ছিল আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইতো। আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম দলের, তাই আমাকে মনে রাখাটা স্বাভাবিক। সে এখনও মাঝে মাঝে বলে সে চেলটেনহাম ওভালে যেত সকাল ৯ টা বাজে এবং ছোট এক মেয়েকে দৌঁড়াতে দেখতো খেলার মাঠের চারপাশে!
ক্রিকেটটা অবশ্য হিলির রক্তে মিশে আছে। কুইন্সল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন হিলির বাবা। আর চাচা সাবেক অজি তারকা ইয়ান হিলিকে তো না চেনার কোনো কারণ নেই। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে অভিষেক ম্যাচটা অবশ্য হিলি নিজের সেরাটা দিতে পারেননি। অভিষেকেই মিস করেন একাধিক ক্যাচ!
অভিষেকের পর থেকে টেস্ট খেলার নেশাটা ছিল হিলির মধ্যে। তবে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট তখন নারীদের টি-টোয়েন্টি নিয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলো। ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট অ্যাকাডেমির দায়িত্বে থাকা সাবেক অজি তারকা বেলিন্ডা ক্লার্ক সবাইকে একত্র করে বললেন, ‘আমরা নারী ক্রিকেটকে আরও এগিয়ে নিতে চাই। আমরা এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটও খেলবো।’
এ ব্যাপারে হিলি বলেন, ‘আমি শুধু ভাবতাম আমি চাচার মতো টেস্ট ক্রিকেট খেলবো। যেটা ছেলেরা করে। আমি ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ চাচ্ছিলাম। আমি তখন শুধু টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চাইতাম। এখন কয়েক বছর পরে বুঝতে পারছি। সেটা অসাধারণ একটা পদক্ষেপ ছিল। এখন আমরা তিন ফরম্যাটেই খেলছি।’
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনালে শেষ উইকেটে যখন মিড অফে ক্যাচ ধরা হলো সাথে সাথেই একটি ক্যামেরায় ভেসে উঠলো হিলির মুখ। হিলিকে তাঁর সতীর্থতা মিডজ নামেও ডাকে। হিলি বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৩২ এবং আমি সবকিছুই দেখেছি। আমাদের দল এমন ইভেন্ট জেতার মত তৈরি করেছে নিজেদের। আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি ফাইনালে সেঞ্চুরি করবো। খুবই ভাল লাগছে।’
বিশ্বকাপের পর হিলির কোচ অ্যাশ স্কোয়ার্স হিলিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘১০ বছর বয়সী হিলিকে তুমি কি বলবে যদি পেছনে ফিরে যাওয়া যায়?’ হিলি উত্তরে বললো, ‘আমি যদি পারতাম আমি আমার বোনকে আরেকটু জড়িয়ে ধরতাম। আমি আমার ১০ বছর বয়সের হিলিকে বলতাম পরিবারের সাথে সময়টা উপভোগ করতে। মারামারি না করে বোনকে জড়িয়ে ধরে থাকতাম।’
বোনের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে আবার ফিরেছিলেন ক্রিকেটে। ক্রিকেটকে আপন করে নিয়ে বাকি পথচলা। স্বামী হিসেবে পেয়েছেন ছোটবেলার বন্ধু মিশেল স্টার্ককে! শোকের ছায়া থেকে বেরিয়ে হিলি এখন অজিদের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক।