লিওনেল মেসি নেই, নেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও। মেসি, রোনালদো-দের সঙ্গেই দর্শকের তালিকায় কিলিয়ান এমবাপ্পে ও নেইমার জুনিয়র। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে এবার তাই তারকাদ্যুতি বেশ কম। চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে উত্তেজনা তাই এবার দলকেন্দ্রিক। আর এই পর্বের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর লড়াই হতে চলছে রিয়াল মাদ্রিদ বনাম চেলসি’র মাঝে।
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ মানেই ভিন্নদেশীয় ক্লাবগুলোর ইউরোপ সেরা হওয়ার লড়াই; এই লড়াইয়ে সবচেয়ে সফল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। সর্ব্বোচ্চ তেরোবার ইউরোপ সেরার মুকুট জিতেছিল তাঁরা। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে তাই ‘সাম্প্রতিক ফর্ম’, ‘প্রতিপক্ষ’ সবকিছুর উর্ধ্বেই হিসেব করা হয় লস ব্ল্যাঙ্কোসদের। অন্যদিকে ইংলিশ ক্লাব চেলসি গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাধারী। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন চেলসি-কেও তাই কোন অংশে পিছিয়ে রাখা যায় না।
এই দুই দলের দেখা অবশ্য গত মৌসুমেই হয়েছিল যেখানে শেষ হাসি হেসেছিলেন দ্য ব্লুজ’রা। সেবার রিয়াল মাদ্রিদকে সেমিফাইনালে হারিয়েই উঠেছিল ফাইনালে, জিতেছিল শিরোপা। সময়ের পালাক্রমে নতুন মৌসুম এসেছে তবে বদলায় নি ভাগ্য। এবারও চেলসি’র মুখোমুখি হয়েছে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। টুর্নামেন্ট একই হলেও মঞ্চটা এবার একটু ভিন্ন; কোয়ার্টার ফাইনালেই লড়তে হবে এই হট ফেভারিট দল-কে।
রিয়াল মাদ্রিদের জন্য চেলসি’র ম্যাচটি অন্য আট দশটি ম্যাচের মত নয়। ম্যাচটি নিজেদের আত্ম-সম্মানের; ঠিক এক বছর আগে লন্ডনের স্টামফোর্ড ব্রিজেই মাথা নিচু করে ফিরেছিল রিয়াল; এবার সময় লজ্জা ফিরিয়ে দেয়ার। ইউরোপের সবচেয়ে বড় আসরে নিজেদের বারবার প্রমান করেছিল, এবার আরেকবার নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শনে নিশ্চয়ই উন্মুখ হয়ে আছে।
অন্যদিকে, চেলসি’র জন্য লক্ষ্য অপরিবর্তিত রয়েছে। তারা চাইবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে এবারও এগিয়ে যেতে রিয়ালকে সরিয়ে। ঘরের মাঠে কিংবা স্পেনের বার্নাব্যু-তে যেকোনো মূল্যে তারা রুখে দিতে চাইবে লস ব্ল্যাঙ্কোসদের। ইতোমধ্যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ হাতছাড়া হয়েছে তাদের, তাই পাখির চোখে রূপালী ট্রফির দিকেই তাকিয়ে আছে লন্ডনের ক্লাবটি।
রাউন্ড অব সিক্সটিনে দুইদলই মুখোমুখি হয়েছিল ফ্রান্সের ক্লাবের বিপক্ষে। যেখানে চেলসি অপেক্ষাকৃত দুর্বল লিলি-কে দুই লেগ মিলিয়ে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিলেও আরেক ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেই অবশ্য রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে জমজমাট একটি ম্যাচ উপহার দিয়েছিল। পিএসজি এগিয়েই ছিল মাঠের পারফরম্যান্সে, তবে দ্বিতীয় লেগে সতেরো মিনিটের এক বেনজেমা-ঝড়ে হেরে গিয়ে পড়েছিল তাঁরা।
পরিসংখ্যান অবশ্য একরকম স্বস্তি দিবে চেলসি-কে। ক্লাবের মালিকানা ইস্যু নিয়ে কিছুটা টালমাটাল থাকা ক্লাবটি ঘরের মাঠে সর্বশেষ পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ম্যাচই জিতেছে ক্লিনশিট সহ। এছাড়াও ২০১০-১১ মৌসুমের পর থেকে কখনোই চ্যাম্পিয়ন্স লীগের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়েনি চেলসি। তবে সর্বশেষ লীগ ম্যাচে ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া চেলসি’র জন্য চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাই প্রোফাইল দল রিয়ালের বিপক্ষে মুখোমুখি হওয়ার আগের ম্যাচে দলের এমন হার নিশ্চয়ই বাড়তি চাপের কারন চেলসি ম্যানেজম্যান্টের জন্য।
অপরদিকে রিয়াল মাদ্রিদ লা লিগার পয়েন্ট টেবিলে সবার উপরে থাকলেও বর্তমান সময়টা খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। এক ক্লাসিকো-তে ৪-০ গোলে হেরে গিয়েছিল তারা, পরের ম্যাচে সেল্টা ভিগো-কে ২-১ গোলে হারালেও ঠিক স্বভাবসুলভ খেলাটা খেলতে পারেনি। অবশ্য চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলতে নামলেই অন্যরূপ ধারন করে অল হোয়াইটরা। সর্বশেষ দেখায় চেলসি’র বিপক্ষে পরাজয় নিশ্চয়ই আরো তাতিয়ে রাখবে স্প্যানিশ জায়ান্টদের।
সাধারণত ত্রি-ম্যান ব্যাক লাইন নিয়ে ম্যাচে খেলতে নামে চেলসি। শক্ত-পোক্ত একটি ডিফেন্স লাইন রয়েছে তাদের, সর্বশেষ পাঁচটি হোম ম্যাচে ক্লিনশিট রাখতে পারা তারই প্রমান। ডিফেন্স লাইনের ঠিক উপরে দুইজন ওয়াইড মিডফিল্ডার এবং দুইজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার থাকে চেলসি দলে। এন’গোলো কান্তে, জর্জিনহো দের নিয়ে গড়া মিডফিল্ডের বিরুদ্ধে লড়া রিয়ালের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সবার উপরে থাকতে পারে একজন স্ট্রাইকার এবং তার পিছনে আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে থাকতে পারে দুইজন।
অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদ সবসময়ের মতই ৪-৩-৩ ফরমেশনে খেলবে। দুইজন ফুলব্যাকের পাশাপাশি ডিফেন্সের দায়িত্বে থাকবে মিলিটাও-আলাবা জুটি। মিডফিল্ডে পরিচিত ক্যাসেমিরো, মদ্রিচ, ক্রুস কে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি; তবে পরিবর্তন আনতে চাইলে ফেদে ভালভার্দে,কামাভিঙ্গার মত অপশন রিয়াল ম্যানেজম্যান্টের হাতে রয়েছে। আক্রমণে সবার আগে আসবে করিম বেনজেমা’র নাম। পিএসজি বধের নায়কের দিকে আরো একবার তাকিয়ে থাকবে রিয়াল ভক্তরা। এছাড়া তরুন ভিনিসিয়াস জুনিয়রের কাঁধেও থাকবে বাড়তি দায়িত্ব।
- চেলসির সম্ভাব্য লাইনআপ
এদুয়ার্দো মেন্ডি, এন্টনি রুডিগার, থিয়াগো সিলভা, চিজার আজপিলিচুয়েতা, রিচ জেমস, এনগোলো কান্তে, জর্জিনহো, মার্কোস অলনসো, হাকিম জিয়েখ, ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ এবং কাই হাভার্টজ।
- রিয়াল মাদ্রিদের সম্ভাব্য লাইনআপ
থিবো কোর্তায়া, দানি কারভাহাল, এডার মিলিটাও, ডেভিড আলাবা, ফারলান্দ মেন্দি, ক্যাসেমিরো, লুকা মদ্রিচ, টনি ক্রুস, মার্কো আসেনসিও/ফেদে ভালভার্দে, ভিনি জুনিয়র এবং করিম বেনজেমা।
চেলসির বর্তমান কোচ টমাস টুখেল কখনোই হারেননি রিয়াল মাদ্রিদের কাছে। ছয়বারের দেখায় সবসময়ই অপরাজিত ছিলেন টুখেল; রিয়ালের বর্তমান কোচ আনচেলত্তি অবশ্য হেড টু হেডে এগিয়ে আছেন জার্মান টেকনিশিয়ানের চেয়ে। এবারও কি টুখেল অল হোয়াইটদের বিপক্ষে তার ‘আনবিটেন স্ট্রিক’ চলমান রাখবেন নাকি আনচেলত্তি দেখাবেন বুড়ো হাড়ের ভেলকি? মাঠের এগারো জনের বাইরেও লড়াই হবে এই দুই দ্বাদশ ব্যক্তির। পা দিয়ে নয়, মাথার খেলায় দুজনেই চাইবেন নিজের দলকে এগিয়ে রাখতে।
চেলসির সামনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সুযোগ, রিয়াল সমর্থকেরা প্রতিশোধের অপেক্ষায়। নানামুখী সমীকরন আর অতীত পরিসংখ্যান ঝেড়ে ফেলে মাঠের লড়াইয়ের অপেক্ষায় দুইদল। কে হাসবে এবার শেষ হাসি? লন্ডনের স্টামফোর্ড ব্রিজে দুইদলের লড়াইয়ের প্রথম ধাপ আগামীকাল রাত দুইটায়। কি ঘটতে চলেছ দুই পরাশক্তির লড়াইয়ে? কে হাসবে এবার শেষ হাসি? রিয়ালের প্রতিশোধ নাকি এবারও প্রহসন? প্রশ্নের উত্তরগুলো তোলা থাকুক সময়ের হাতে।