২০১৮ সালে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। মুখোমুখি হয়েছিল দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও ভারত। ভারতের ইনিংসের আঠারো তম ওভারে বল করতে এলেন এক বাংলাদেশি পেসার। ওভারের তৃতীয় বলটা সরাসরি আঘাত হানলো স্ট্যাম্পে; ক্লিন বোল্ড ভারতীয় ব্যাটসম্যানের পৃথ্বী শ।
সুইং আর গতির মিশেলে দুর্দান্ত একটি ডেলিভারি কিন্তু ডেলিভারি-টি স্মরনীয় হলো অন্য কারনে; টিভি পর্দায় বলের গতি দেখাচ্ছিল ঘন্টায় ১৬০ কিলোমিটার। প্রায় চার বছর আগের ঘটনাটি মনে আছে? মনে আছে বোলারের নামটি? বাংলাদেশী সে পেসারের নাম কাজী অনিক ইসলাম।
১৬০ কিলোমিটার গতিতে বল করে সেসময় বিশ্ব মিডিয়া তোলপাড় করে দিয়েছিল এই টাইগার বাহাতি। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের কোন আফ্রিকান কিংবা অজি পেসাররা যা করতে পারেননি সেটিই কি তবে করে দেখিয়েছেন অনিক, প্রশ্ন উঠেছিল দর্শকমহলে। যদিও পরবর্তীতে সেটি টেকনিক্যাল ভুল বলেই ঘোষণা দিয়েছিল ম্যাচ কতৃপক্ষ তবে দারুণ গতি ও সুইয়ের কারণে বেশ ভ্রম সৃষ্টি হয়েছিল। টেকনিক্যাল ভুল ঘোষনা না দিলে হয়তো সন্দেহ থেকেই যেত।
শুধু ওই একটি ডেলিভারিই নয়, সে ম্যাচে ৪২ রানে তিন উইকেট শিকার করেও দারুণ পারফরম্যান্স করেছিলেন কাজী অনিক। বাঁহাতি এই পেসার প্রথম থেকেই ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের আগ্রহের কেন্দ্রতে, ঘরোয়া ক্রিকেটেও শুরুটা ছিল সম্ভাবনা-জাগানিয়া। খেলেছিলেন বিপিএলেও, হয়তো জাতীয় দলে দেখাটাও সময়ের ব্যাপার ছিল তখন।
কিন্তু ফুল হয়ে ফোটার আগেই জীবনের অন্ধকার দিকটি দেখা হয়ে যায় কাজী অনিকের। নিষিদ্ধ ড্রাগস গ্রহন করেছিলেন, ডোপ টেস্টে হয়েছেন পজিটিভ। ফলাফল দুইবছরের নিষেধাজ্ঞা। ধীরে ধীরে ক্রিকেট ভক্ত আর মিডিয়া থেকেও দূরে চলে গিয়েছিলেন। অঙ্কুরেই একজন সম্ভাবনাময়ী ফাস্ট বোলারের সমাপ্তি ধরে নিয়েছিল অনেকেই।
ঢাকার ছেলে কাজী অনিক নিজে তেমনটা ভাবেননি। সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সঙ্গদোষে ড্রাগসের কবলে পড়েছেন, এখন থেকে বদলে নিবেন নিজেকে; আবার ফিরবেন ক্রিকেটে। কথাগুলো সাক্ষাৎকারেই বলেননি শুধু; নিজের অন্তরেও গেঁথে নিয়েছিলেন। তাই লাইমলাইট থেকে দূরে সরেও লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন এতদিন, অপেক্ষায় ছিলেন আরেকটি সুযোগের।
নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর চলতি বছরের ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে প্রথম সুযোগ পান কাজী অনিক। গাজী গ্রুপ অব ক্রিকেটার্স ভরসা রাখে এই তরুণের উপর। ভরসার প্রতিদান দিতে ভুল হয়নি অনিকের, ভুল হয়নি নিজেকে প্রমান করতে।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষ উইকেট শিকারী বোলারদের তালিকায় উপরের দিকেই রয়েছে কাজী অনিক ইসলামের নাম। এখন পর্যন্ত আট ম্যাচ খেলেছেন তিনি। প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের পনেরো বার ফিরিয়েছেন প্যাভিলনে৷ আট ম্যাচে পনেরো উইকেট; স্ট্রাইক রেট মাত্র ২০ এর একটু বেশি! ইকোনমিটাও দারুণ, ৫ এর একটু উপরে।
টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে যেখানে প্রতিপক্ষ লিজেন্ড অব রূপগঞ্জ তুলেছিল ২৯১ রান সেখানেও কাজী অনিকের বোলিং ফিগার ১০-০-৩৬-৩! এমন দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনের পর ধারাবাহিকতাও ধরে রাখা ছিল অনিকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ; সেখানেও উৎরে গিয়েছেন এই পেসার।
গাজী গ্রুপের হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচে আরো ক্ষুরধার হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ত্রিশ রানের বিনিময়ে ছয় উইকেট নিয়ে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছেন সিটি ক্লাবের ব্যাটিংলাইনআপ-কে। জিতেছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারও।
সংখ্যার হিসেবেই বোঝা যায় যথেষ্ট ভাল বোলিং করেছেন কাজী অনিক। তবে এমন কিছু রয়েছে ক্রিকেটে যা শুধুই চোখে দেখার মত; সংখ্যায় ফুটিয়ে তোলা যায় না। নিঁখুত লাইনলেন্থ, প্রয়োজনের সময় উইকেট, একজন বোলার হিসেবে অধিনায়কের আস্থা অর্জন; কাজী অনিকের বোলিংয়ে সবই পাওয়া গিয়েছে। কোন স্পেলে উইকেট না পেলেও বোলিংয়ে ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন এই তরুণ পেসার।
তবে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল সবসময়ই। তাই ঘরোয়াতে এমন পারফরম্যান্স নিয়ে হয়তো বেশি সন্তুষ্টির জায়গা নেই। তবে আড়াই বছর পরে ক্রিকেটে ফিরেই এমন পারফরম্যান্স, আপনাকে কাজী অনিককে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে। বাধ্য করবে যে সম্ভাবনা’র মৃত্যু ঘটেছে ধরে নিয়েছেন তাকে আবার নতুন করে জাগ্রত করতে।
বাংলাদেশে যে হঠাৎ করেই একটি পেস বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে তারই অংশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে প্রাথমিকভাবে সফল এই বাঁ-হাতি। তবে এখনও পথ বাকি অনেকটা। যে দৃঢ়প্রত্যয়ে ফিরেছেন নতুন করে, ফিরেছেন রাজসিক ভাবে সে দৃঢ়তা নিয়েই তিনি হয়তো পাড়ি দিবেন বাকি পথ। মুস্তাফিজুর কিংবা শরীফুলের মতই হয়তো সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবেন একটি পেস-ইউনিটের।
এখনও সবই ভবিষ্যত; ভবিষ্যতে কি ঘটবে সেটি তো নিশ্চয়তা নিয়ে বলা যায় না। তবে যেভাবে ফিরেছেন কাজী অনিক, তাকে নিয়ে নতুন করে গল্প বলতেই হচ্ছে; নতুন করে একটি আশা’র বৃত্ত সৃষ্টি হয়েছে তাকে ঘিরে। নেভিল কার্ডাসের ক্রিকেটের উত্থান যেমন আছে, আছে পতনও। কাজী অনিক ইসলামের পতন তো দেখা শেষ, এখন উত্থান দেখবো তো?