চিত্র পরিচালক সৃজিত মুখার্জি তাঁর ‘হেমলক সোসাইটি’ ছবিতে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণায় আক্রান্ত, আত্মহত্যায় উদ্যত প্রধান চরিত্রকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনার টোটকা হিসাবে যে মোদ্দা কথাটি ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করেছিলেন তা হল, ‘ওহে, তোমার চেয়েও জীবনে অনেকে অনেক বেশি কষ্ট নিয়ে বেঁচে রয়েছে। অতএব তোমার নাকি কান্না থামিয়ে চটপট জীবনে ফিরে যাও।’
তা ২০০৬ সালের ১২ মার্চ, জোবার্গে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস শেষে জ্যাক ক্যালিসও নাকি খানিকটা এরকমই কিছু বলেন, ‘আরে আমরা ভালোই বল করেছি। অস্ট্রেলিয়া অন্তত কুড়ি রান কম করেছে। আরও খারাপ হতে পারতো। এবার ব্যাটারদের বাকি কাজটা করার পালা।’
তা এই বাক্য বন্ধটি ক্যালিস না বলে যদি জোহানেসবার্গের মাঠে উপস্থিত থাকা কোনো দর্শক বলতেন, পাশের চেয়ারে বসা দর্শকটি সম্ভবত চরম বিরক্ত হয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যেতেন, বা তাঁর উগ্রতম আশাবাদী সহনাগরিককে বলতেন, ‘ধুর মশাই। ইয়ার্কি পেয়েছেন নাকি?’
কিন্তু ক্যালিসের করা মন্তব্যটি নাকি ৪৩৪ রানের ভ্যাপসা গন্ধে ভরা দক্ষিণ আফ্রিকান ড্রেসিংরুমে ক্ষণিকের নির্মল হাসির বাতাস বইয়ে দেয়। তার ঘন্টা চারেক বাদে যে ক্যালিসের বক্তব্যটি হাড়ে হাড়ে সত্য প্রমাণিত হবে কে জানতো? এবং তার প্রধান কান্ডারি হবেন এমন একজন যিনি প্রায় সেদিন খেলার মতো অবস্থাতেই ছিলেন না।
হার্শেল গিবস দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র। ড্রাগস, নারীসঙ্গ, অপ্রতুল আমোদ উল্লাস-গিবসের এর সবকটি গুনই ছিল। তা ১১ মার্চ, ২০০৬ গিবস একটু বেশিই আমোদ উল্লাসে মত্ত হয়ে পড়েন। এতটাই যে, তার রেশ নাকি ছিল পরদিন সকাল অবধি। আরেকটু হলে তো টিম বাস মিস করে ফেলছিলেন। ডে-নাইট ম্যাচ হলে তবু খানিক জিরিয়ে নেবার সময় পেতেন। আহাম্মকরা সেদিনের ম্যাচটিই সকাল সাড়ে নয়টা থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন।
তা কি আর করা। রোববার কিঞ্চিৎ বেশি মদ্যপান করার পর কর্পোরেট কর্মীর যেমন সোমবার সকালটি যায়, গিবসের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁর হ্যাংওভার কাটে মোটামুটি ক্রিজে ব্যাটিং করতে নামার পর। এসব কিন্তু বানানো গল্প নয়। গিবস নিজেই লিখেছেন।
হ্যাংওভার কাটানোর জন্য যেমন ঘনঘন লেবুর জল পান করেন অনেকে, গিবস অস্ট্রেলিয়ার বোলিংকে তাঁর ‘লেবুর সরবত’ বানিয়ে ফেলেন। গিবসের কৃপা দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি স্নাত হন মিক লিউইস। গিবস এমন ব্যাট করছিলেন সেদিন, ১৭৫ এ মারতে গিয়ে আউট না হলে একদিনের ক্রিকেটে প্রথম ২০০ দেখার জন্য ক্রিকেটমোদিকে ২০১০ এর অপেক্ষা করতে হতো না।
‘সময়ের চেয়ে এগিয়ে’ বিশেষণটি এখন সর্বক্ষেত্রে এত বেশি ব্যবহৃত হয়, যে বিশেষণটির জৌলুসে খানিক মর্চে ধরেছে। তবে ১২ই মার্চ ২০০৬ এর ম্যাচটির ক্ষেত্রে বিশেষণটি একেবারে খাপে খাপ বসে যায়। মনে রাখতে হবে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট তখন সবে হাঁটতে শিখছে। কাজেই গোটা ম্যাচ জুড়ে ১০০ ওভারে ৮৭২ রান এতটাই অলৌকিক যে আজকের টি-টোয়েন্টির গরিমার যুগেও ভাবা যায় না। সে যুগে তো ২৭০ মানেই অনেক রান।
এই ম্যাচটি বড় রান তাড়া করার একটি চিরকালীন টেমপ্লেট হয়ে থেকে যাবে। মহেন্দ্র সিং ধোনির ব্যাটিং স্কুল এক্ষেত্রে ততটা কার্যকরী নয়। ম্যাচ শেষ ওভারে নিয়ে যাও জাতীয় টেমপ্লেট ৩০০র চেজে খেটে যায়। তাও ধোনি বা মাইকেল বেভানের মতো কেউ কেউ ছাড়া এই টেমপ্লেটের প্রয়োগ সফলভাবে বিশেষ কেউই করতে পারেননি।
কিন্তু গিবস ও স্মিথ যেভাবে খেলছিলেন সেদিন ৩২০র ওপর রান তাড়া করতে গেলে ঠিক সেভাবেই খেলা দরকার। সব সময় আস্কিং রেটের চেয়ে দু কদম এগিয়ে থাকো। কোহলির কয়েকটি অবিস্মরণীয় বড় ইনিংস কিছুটা এই টেমপ্লেট মেনেই খেলা। যেমন রাজকোট ও নাগপুর ২০১৩। যেমন পুনে ২০১৭।
জোবার্গের মাঠ এমনিতে যে কয়েকটি জিনিসের জন্য বিখ্যাত, ওয়ানডে ম্যাচে পাটা উইকেট তার মধ্যে একটি। ২০০৩ এর ফাইনাল খেলা যেকোনো ভারতীয় এ ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রমাণাদি দিয়ে দেবেন। বা ২০১৫ সালে ডিভিলিয়ার্সের হাতে আধমরা হওয়া যেকোনো ক্যারিবীয় বোলার। কিন্তু উইকেট যতই পাটা হোক, ৪৩৪ তাড়া করতে গিয়ে সেটা স্কোরবোর্ডের চাপে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবার কথা। যেমন ২০০৩ এর ফাইনালে বা ২০১৫র ম্যাচটিতে হয়েছিল। ৪৩৪ করতে পাটা উইকেট নয়, লাগে বুকের পাটা।
এই ৮৭২ ম্যাচের আগে ক্রোনিয়ের দক্ষিণ আফ্রিকা পূর্বতন শ্রেষ্ঠ ওয়ানডে ম্যাচটিতে এই বুকের পাটার অভাবেই জিততে পারেনি। এজবাস্টন ’৯৯ এর কথা বলছিলাম। হ্যান্সি ক্রনিয়ের উত্তরসূরী গ্রায়েম স্মিথের দল ঠিক এই বুকের পাটার জোরেই ইতিহাস সৃষ্টি করে।