মাথায় কমলা রঙের টুপি আর মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি। টুপিটা যেন তাঁর মাথাতেই শোভা পাচ্ছে। এই কমলা টুপির শোভাও যেন বেড়ে গেছে কয়েকগুন। এগারো জনের মাঝে থেকেও দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এই টুপিটাই হয়ত এবার বাড়ি ফেরার পথে ব্যাগের এক কোণে ঠিক জায়গা করে নিবে। এই টুপির মাহাত্ম্য অনেক। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের মাথায় চড়ে পুরো ম্যাচেই ২২ গজে ছুঁটতে থাকে।
তিনি ছুঁটছেন অদম্য গতিতে। রান বন্যায় ভাসাচ্ছেন ম্যাচের পর ম্যাচ। বোলারদের বেধরক পিটিয়ে বলকে আঁছড়ে ফেলছেন বাউন্ডারির বাইরে।
কভার, পুল, লং অন কিংবা মিড উইকেট – ব্যাটে বলে ঠিকভাবেই হলেও বাউন্ডারি। নান্দনিক সব শটের পসরা সাজিয়ে বসেছেন, সাথে আছে দুর্দান্ত টাইমিং। ২২ গজে শিল্পীর তুলির আঁচড় দিচ্ছেন। ব্যাট নামক তুলি হাতে ২২ গজের সবুজ ক্যানভাসে অনিন্দ্য সুন্দর ছবি আঁকছেন। চোখে-মুখে নেই ক্লান্তির ছাপ, তাঁর ব্যাটিং মানেই চোখের প্রশান্তি। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায়।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) পঞ্চদশ আসরে ব্যাট হাতে অদম্য রাজস্থান রয়্যালসের ওপেনার জশ বাটলার। তিনি ব্যাটিংয়ে নামা মানেই যেন প্রতিপক্ষের জন্য এক আতংক। প্রতিপক্ষের বোলারদের জন্য কপালে চিন্তার দাগ। আসরের প্রথম সাত ম্যাচেই নিজেকে নিয়ে গেছেন বাকিদের চেয়ে অনেক উপরে। একের পর এক রেকর্ডে নিজের নামটা লিখছেন ব্যাট হাতে।
দিল্লী ক্যাপিটালসের বিপক্ষে ৬৫ বলে ১১৬ রানের দানবীয় ইনিংসের পথে করলেন এবারের আসরে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি। ৯ ছক্কা, ৯ চার। স্ট্রাইক রেট ১৭৮.৪৬। আইপিএলে এক আসরে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরিতে বিরাট কোহলির পর দ্বিতীয়তে অবস্থান বাটলারের। এছাড়া আইপিএল ইতিহাসে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির তালিকাতে আছেন তিনে। এবারের আসরে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রানের মালিক তিনি। হুমকিতে আছে বিরাট কোহলির ২০১৬ সালে করা ৯৭৩ রানের রেকর্ডও।
ব্যাট হাতে টি-টোয়েন্টিতে বাটলার অপ্রতিরোধ্য লম্বা সময় ধরেই। বাটলারের এই বদলে যাওয়ার পেছনের কারণ তাঁর ব্যাটিং পজিশন। ওপেনিংয়ে উঠে আসার পর থেকেই ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষের জন্য যমদূত রূপে নিজেকে জাহির করেছেন বাটলার।
ওপেনিংয়ে এখন পর্যন্ত ২৮ ইনিংসে ৫৭ গড়ে ১১ ফিফটি আর ১ সেঞ্চুরিতে করেছেন ১১৪৪ রান! অপরদিকে চার, পাঁচ, ছয় ও সাত নম্বর পজিশনে ৫২ ইনিংসে মাত্র ২৪ গড়ে ১৩৪ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন মাত্র ৯৯৬ রান! বাকি পজিশনগুলোর পারফরম্যান্সের তুলনায় ওপেনিংয়ের পারফরম্যান্সে আকাশ-পাতাল পার্থক্যটা স্পষ্ট।
৭ ম্যাচ, ৪৯১ রান। গড় ৮১.৮৩, স্ট্রাইক রেট ১৬২ প্রায়। ৩ সেঞ্চুরি, ২ ফিফটি। ৩২ ছক্কা, ৪১ চার।
বাটলার তাণ্ডবের বিধ্বংসী রূপের প্রমাণটা স্পষ্ট এই পরিসংখ্যানে। বাটলারের এই রূপের সামনে বোলারদের অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়াও উপায় নেই। বোলারদের কোনো কৌশলই পাত্তা পাচ্ছে না বাটলার দাপটের সামনে।
দৃষ্টিনন্দন কভার ড্রাইভ কিংবা মিড উইকেটের উপর দিয়ে নজরকাঁড়া ছক্কা। পুল শটে বাউন্ডারি কিংবা পেসারদের বিপক্ষে স্কুপ শট – বাটলারের ঝুলিতে শটের কমতি নেই। ফুলার লেন্থ বা লো ফুলটস কিংবা বাউন্সার – কোনো কিছুই দমাতে পারছেনা বাটলারকে।
বলকে বাউন্ডারি ছাড়া করাটাই তাঁর মূল লক্ষ্য। ইনিংসের প্রথম বল থেকেই তিনি চেষ্টা করেন বোলারের উপর চড়াও হওয়ার। তাঁর দিনে বোলাররাও যে থাকেন নিরুপায়! প্রতিপক্ষের অধিনায়কও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে থাকেন বাটলার শো!
কব্জির জোরের কারণে অনায়াসে বাউন্ডারি পার করতে পারেন। ছোটবেলা থেকেই রাগবি, হকি, টেনিস আর ফুটবলে ছিলেন সমান পারদর্শী। যার জন্য হাতে কব্জির জোরটাও স্বাভাবিকভাবে একটু বেশি। একটু বেশি না বলে অনেক বেশি বললেও ভুল হবে না।
একটা সময় আইপিএল মানেই যেন চোখে ভেসে উঠত ইউনিভার্স বস খ্যাত ক্রিস গেইলের তাণ্ডবময় ব্যাটিং। প্রতিপক্ষের বোলারদের জন্য ছিলেন যমদূত। ক্রিস গেইল এখন নেই। সেই ইউনিভার্স বস যেন এখন জস দ্য বস রূপে ফিরেছেন।
বাটলার কোথায় থামবেন তিনি নিজেও জানেন না। আসরের বাকি এখনও অনেকটা। নিজেকে কতটা উপরে নিয়ে যেতে পারবেন তা জানতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে টুর্নামেন্ট শেষ হওয়া অবধি। আসছে মাস কয়েক বাদেই অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এবারের আসর। বাটলারের এই ফর্ম আর ধারাবাহিকতা ইংল্যান্ডের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস কিন্তু প্রতিপক্ষের জন্য এক অশুভ বার্তা।