বাংলাদেশি বোলারদের আক্ষেপকথন

দেখতে দেখতে প্রায় দুইটি দশক পার করে ফেলেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট অঙ্গণে। কতশত জয়ের কাব্য হল, সে সাথে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে কান্না জর্জরিত এক একটি ‘ট্রাজেডি’ লেখা হয়ে গেল। তবুও চলতে চলতে আমরা একটা পর্যায় এসেছি। এখন অন্তত ওয়ানডে ফরম্যাটে আমরা প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে জয় ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পারি।তবে এই যে একটি ফরম্যাটে খানিক একটা শক্ত খুঁটি গেড়ে বসতেও ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্পের শেষ নেই।

কিন্তু এরই মাঝে যে আরও কিছু আক্ষেপ আমাদের ক্রিকেটের পথচলায় যুক্ত হয়েছে তাঁর খেয়াল কিংবা খবর কি আমরা রাখি? বোধ হয় রাখিনা। আমাদের ক্রিকেটের এই পথচলায় বহু বোলার যুক্ত হয়েছেন, আবার তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন কারণে হারিয়েও গেছেন দৃশ্যপট থেকে। এমন সব বোলারদের নিয়ে গল্প হবে হবে আজ, আবারও আক্ষেপের।

  • শফিউল ইসলাম

লিকলিকে গঢ়নের শফিউল ইসলাম, একজন পেস বোলার। বিশ্বমানে বোলিং করতেন তা বলার উপায় নেই। তবে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মত বোলার তিনি ছিলেন। সেদিক বিবেচনায় আবার বেশ ভাল বোলারই ছিলেন। তবে তাঁর উন্নতির জায়গা ছিল। তিনি হয়ত নিজেকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু খাবারের প্রতি যেমন তাঁর অনীহা ঠিক তেমনি হয়ত ভাগ্যেরও তাঁর প্রতি অনীহার শেষ নেই। তাইতো তিনি ইনজুরির গ্যাড়াকলে পীষে নিজেকে সময়ে সময়ে হারিয়েছেন। দশটা বছর জাতীয় দলের আশেপাশে থেকেও ৬০টির বেশি ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে পারেননি শফিউল।

সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে যুক্ত হয়েছেন ঠিক। আলোড়নও সৃষ্টি করেছেন বহুবার। তবে তিনি যেন এক ব্যর্থতার চক্রে ফেঁসে গিয়েছিলেন। নিজেকে ছাপিয়ে যাবার, দলের চাহিদা পূরণ করবার মত তেমন কোন ধারালো অস্ত্র হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পারেননি। ক্রিকেট সময়ের সাথে বদলে যাচ্ছে ভীষণ রকম। তবে শফিউল সেই পরিবর্তনের হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারছেন না বা চাইছেন না।

তিনি যেন এখানটায় স্রোতের বিপরীতে বিদ্রোহ করতে চাইছেন। তবে সে বিদ্রোহ শুধু মাত্র তাঁর জীবনের আক্ষেপটাকে বাড়িয়ে দেবে। শফিউলকে ঘিরে প্রত্যাশার ঘর বেঁধেছিল অনেকেই। শফিউল নিজেও হয়ত বেঁধেছিলেন। নিশ্চয়ই আবার তিনি ফিরে আসতে চাইবেন জাতীয় দলে। সেজন্য সকল আক্ষেপ ঝেড়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। ইনজুরির দুষ্টচক্র থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।

  • রুবেল হোসেন

একটা সময় আমাদের পেস বোলার কিংবা গতিশীল পেস বোলারের সংকট ছিল। সে সংকটের একটা প্রতিকার হয়ে হাজির হয়েছিলেন রুবেল হোসেন। নির্দিষ্ট লাইন লেন্থে গতির ঝড় তুলতে তিনি বেশ পটু। একসময় যখন বাংলাদেশের পেসে গতির খরা তখন তিনি বৃষ্টি নামক আশীর্বাদ। তাঁর গতিতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। তাঁর গতিতে বধ হয়েছে বড় বড় সব ক্রিকেট পরাশক্তি।

২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের শেষ উইকেট তুলে নিয়ে তাঁর ছুটে চলা এখনও চোখের সামনে স্পষ্ট। একটা লম্বা সময় তিনি ছিলেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিতর্ক, ইনজুরি সবকিছু কাটিয়ে উঠে তিনি আবার ঠিকই দলে, একাদশে নিজের জায়গাটা করে নিয়েছেন। তবে তিনিও যেন সেই শফিউলের মত ক্রমশ একরাশ আক্ষেপের জন্ম দিয়ে চলে যাচ্ছেন আড়ালে।

তিনি এখন আর জাতীয় দলের সাথে নেই। বেশকিছু দিন কাটিয়েছেন ডাগআউটে, একাদশে সুযোগ মেলেনি তাঁর। মূলত নিজের জায়গাটা ধরে রাখার মত পরিশ্রম তিনি করছেন কি না সে নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। তাছাড়া তাঁর কার্য্যকারিতাও দিন দিন কমে আসছে। আর অতিরিক্ত রান খরচের পাশাপাশি বৈচিত্র্যের অভাবে ক্রমাগত তাঁর এবং জাতীয় দলের দূরত্ব বেড়েই চলেছে।

  • আল আমিন হোসেন

টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার আল আমিন হোসেন। পেসারদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তাঁর উইকেট সংখ্যা ৪৩টি। অথচ তিনি আজ বাকি ফরম্যাট তো দূরে থাক এই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের জন্যেও বাংলাদেশ জাতীয় দলে বিবেচিত হননা। এক সময় তিনি ছিলেন রীতিমত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় দলে প্রবেশের বেশ আগে থেকেই তিনি ছিলেন আলোচনায়।

ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের গতি আর সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে তিনি স্বপ্নে বুক বেঁধেছিলেন জাতীয় দলে কাণ্ডারি হবার। তিনি হয়েছিলেনও। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যখন করুণ অবস্থা তখন তিনি এসেছিলেন জাতীয় দলে। প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জাতীয় দলে। তাঁর সবচেয়ে পছন্দের ফরম্যাট ছিল টি-টোয়েন্টি। সে ফরম্যাটটায় বাংলাদেশের এখনকার অবস্থানও খুব একটা সুবিধাজনক নয়।

এখন ও খাবি খায় গোটা দল। সে সাথে দলের বাইরে থেকে খাবি খাচ্ছেন আল আমিন। নিজেকে ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে তিনি এখন বড্ড মশগুল। তবুও ধারাবাহিকতার অভাব। নিজেদেরকে নিয়ম করে আরও বেশি শাণ দেওয়ার অভাবের কারণে আরও একজন সম্ভাবনাময় তারাকা হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। অথচ এই আল আমিনের উপর ভরসা করেই আমরা টি-টোয়েন্টিতে লড়াই করতে পারতাম।

  • আরাফাত সানি

বাংলাদেশ ক্রিকেট বা-হাতি স্পিনারদের মানদণ্ড একটু উঁচু। সে মানদণ্ডটা ঠিক করে দিয়ে গেছেন মোহাম্মদ রফিক। সবাই তো আর রফিক না। তাছাড়া কেউ তো কার মত না। হয় কেউ ছাড়িয়ে যাবেন তাঁকে কিংবা পড়ে রইবেন তাঁর পেছনে। তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি আরাফাত সানি। তিনি সে পাস নম্বরটা টপকে যেতে পারেননি। এই একটা কারণ দেখিয়ে হয়ত আরাফাত সানির বাদ পড়াকে ব্যাখা করা যায়।

তবে আসলেও আরাফাত সানি গড়পরতা মানের ছিলেন নাকি তাঁর থেকেও মান খানিক কম ছিল সে প্রশ্নও কিন্তু করা যায়। তবে সেসব করার আগে অবশ্য তাঁকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। সে সুযোগটাই তো ঠিকঠাক মত পাননি তিনি। জাতীয় দলের রঙিন পোশাকে তিনি ম্যাচ খেলেছেন সর্বসাকুল্যে ২৬টি। একজন বোলারকে আপনি ভিন্ন দুই ফরম্যাট মিলিয়ে মাত্র ২৬ ম্যাচেই কি যাচাই করে ফেলতে পারেন?

না, সেটা সম্ভব না। তবে আরাফাত সানির ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। তিনি যে তাঁর ওই সামান্য সুযোগ কাজে লাগাননি তা বলাও যুক্তিসংগত নয়। তিনি চেষ্টা করেছেন, উইকেট নিয়েছেন ৩৬টি। তবে ঐ যে মানদণ্ডের চাপ আর দলে সাকিব আল হাসান এই দুই মিলিয়ে তিনি আসলে বিবেচিত হয়েছেন গড়পরতা হিসেবে। যার ফলস্বরুপ তিনি আজ জাতীয় দল থেকে বেশ খানিকটা দূরে।

  • এনামুল হক জুনিয়র

সেই বা-হাতি স্পিনারের মানদণ্ডে আবারও ফেলা হয়েছিল এনামুল হক জুনিয়রকে। তবে সে মানদণ্ডের থেকেও বেশি তাঁকে সামলাতে হয়েছে প্রতিযোগিতা। তিনি যখন জাতীয় দলে পা রাখেন তখন দলে ছিলেন মোহাম্মদ রফিক। কিছুদিন বাদেই আগমন ঘটে আবদুর রাজ্জাকের। দিন যেতে না যেতে তরুণ সাকিব আল হাসানও এসে হাজির হন দৃশ্যপটে।

সুতরাং তাঁকে ঠিক কতটা প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়। তবে সে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারার দোষ নিশ্চয়ই তাঁর উপর বর্তায়। অথচ সময়টা খানিক ভিন্ন হলেই তিনি হতে পারতেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা স্পিন বোলিং অস্ত্র। কিন্তু সেটা আর হল কই? তিনি তো তীব্র স্রোতে ছিটকে গেলেন জাতীয় দল থেকে।

এরপর আর খুব বেশি সুযোগ পাওয়া হয়নি তাঁর। কালেভদ্রে কারও অবর্তমানে তাঁকে হয়ত ডাকা হয়েছে দলে। তবে তিনি আর কখনোই থিতু হতে পারেননি জাতীয় দলে। খুবই স্বল্প দৈর্ঘ্যের এক ক্যারিয়ার নিয়েই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তিনি নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকে এক আক্ষেপ হিসেবে মেনে নিলেও ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা থেকে এখন অবধি ছাড়েননি ঘরোয়া ক্রিকেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link