অবসরে চলে যাওয়া একজন খেলোয়াড়, দেশের প্রেসিডেন্টের ফোনকলে সাড়া দিয়ে, বিশ্বকাপ একাদশে নাম লিখিয়ে, বেঞ্চে থেকে মাঠে নেমে দলকে জিতিয়ে ফিরলেন। এমন দৃশ্য ফুটবল ইতিহাসে নেই বললেই চলে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। বলছি ১৯৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুন জাতীয় ফুটবল দলের রজার মিলার কথা।
বিশ্বকাপ দল নির্বাচনের আগে তখন রিইউনিয়ন দ্বীপে শান্তিতে অবসর কাটাচ্ছিলেন সম্প্রতি জাতীয় দল থেকে অবসর নেয়া রজার মিলা। তখনই হঠাৎ স্বয়ং রাষ্ট্রপতির ফোন। ১৯৯০ বিশ্বকাপে অবসরে থাকা মিলাকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে দেখতে চান তিনি। রাষ্ট্রপতির অনুরোধ কি আর ফেরানো যায়!
ফোরফোরটু-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রজার মিলা স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘আসলে আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমি ফ্রান্সে পেশাদার ফুটবল খেলতে খেলতে তখন হাঁপিয়ে উঠছিলাম। রিইউনিয়ন দ্বীপে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে চলে গিয়েছিলাম। শেষ নয় মাসে কেবল একটা স্থানীয় ফুটবল দলের সাথে একটা ম্যাচ খেলা হয়েছিল। বিশ্বকাপের মাস ছয়েক আগে ক্যামেরুন গিয়েছিলাম। থিওপাইল আবেগার সাথে আমার কথা হয় (১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপে মিলার সতীর্থ)। মানুষ তখন আমাকে প্রশ্ন করতো, কেন এত আগে-ভাগে অবসর নিয়ে ফেললাম। এরপর রাষ্ট্রপতিও অনুরোধ করলো।’
আজকালকার যুগে এটা একদমই অসম্ভব ব্যাপার। তবে, সেই অসম্ভবকে সম্ভবই শুধু নয়, রজার মিলা সৃষ্টি করেছিলেন অভিনব এক ঘটনার। রহস্যটা কি? তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, ফুটবল খেলতে আমার পা প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু, ফুটবল তো আর পুরোটাই শরীরের খেলা হয়। আমি সব সময়ই খুব বুদ্ধিদীপ্ত একজন ফুটবলার ছিলাম। তাই আমার ধারণা ছিল একবার শরীরটা ফিরে পেলেই আমার ভালো করার সুযোগ থাকবে। প্রথমে ফিট হওয়ার লক্ষ্যে নিয়ে এগিয়েছি, বাকি সিদ্ধান্তটা ছেড়ে দিয়েছিলাম কোচের ওপর।’
এমনকি তৎকালীন কোচ ভ্যালেরি নেপোমনিয়াচিও দলে চাননি মিলাকে। কিন্তু সরকারি চাপে তাঁর সামনে কোনো পথ খোলাও ছিল না। তবে, ফিটনেস নিয়ে মিলা নিজেও বেশ কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো তখন খেলাই ছেড়ে দিয়েছি। আমাকে ফিটনেস ফিরে পেতে অনেক কষ্টদায়ক আর কঠিন অনুশীলনের মধ্য দিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে প্রীতি ম্যাচগুলোতে আমি সেরা খেলোয়াড় ছিলাম। ফলে কোচের মন জিতে নেওয়াটা সহজ হয়েছে।’
বিশ্বকাপের মাঠে যেন নতুন করে নিজেকে ফিরে পেলেন রজার। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে তাকে মাঠে নামানো হলে দুই গোল করে নিজেদের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ করে নিলো এবং তার কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সময়ের জোড়া গোল দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে।
বিস্ময়কার পারফরম্যান্স। রহস্যটা কি? মিলা বলেন, ‘একটু বিস্ময়কর তো বটেই। যোগ্যতা বা টেকনিক্যালি কতটা ভালো আমি ছিলাম, সেটা জানি। তবে শারীরিকভাবে অবশ্যই এটা বড় বিস্ময় ছিল।’
কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-২ গোলে হেরে বাড়ি ফিরতে হয়। তবুও গর্বিতই ছিল মিলার দল। তিনি বলেন, ‘আমরা আনন্দিতই ছিলাম। হ্যাঁ, ইংল্যান্ডের কাছে আমরা হেরেছিলাম, তবুও এটা ভেবে গর্বিত ছিলাম যে আমরা দারুণ একটা টুর্নামেন্ট কাটিয়েছি। ১৯৯০ বিশ্বকাপটা আমাদের জীবনের চিরস্মরণীয় এক অধ্যায়। এই স্মৃতি কখনোই ভুলবো না। দেশে ফেরার পর সামরিক বাহিনীর বাহনে করে ইয়াওন্ডেতে আমাদের নিয়ে আসা হয়। হাজার হাজার মানুষ আমাদের বরণ করে নেয়। এটা ছিল দারুণ একটা অভিজ্ঞতা।’
তবে, বড় একটা সুযোগ যে হাতছাড়া হয়ে গেছে, সেটা মানেন মিলা। তিনি বলেন, ‘আমরা ১-০ গোলে পিছিয়ে ছিলাম। এরপর ডি বক্সে পল গ্যাসকোয়েন একটা ফাউল করেন। ইমানুয়েল কুন্ডে পেনাল্টি থেকে গোল করেন। এরপর ইউজেনে একেকে আমাদেরন ২-১ গোলে এগিয়ে নেন। আমরা এগিয়ে গিয়ে খেলছিলাম, দর্শকরাও আমাদের উত্সাহ যোগাচ্ছিল। ফুটবল ছিল আমাদের বড় বিনোদন, অবশ্যই আমরা জয়ই চাইছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি।’
সেবার টুর্নামেন্ট জুড়েই নজর কেড়েছিলেন রজার। বিশেষ করে গোল করার পর তাঁর উদযাপনটাও ছিল বেশ আকর্ষণীয়। রোমানিয়ার বিপক্ষে গোল করে কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে গিয়ে নেচে নেচে উদযাপন করেছিলেন। মিলা বলেন, ‘ওটা ছিল স্বত:স্ফূর্ত একটা উদযাপন। আগে কখনো ওটা করিনি, অনুশীলনেও নয়।’
দ্বিতীয় পর্বে কলম্বিয়ার গোলরক্ষক রেনে হিগুইতার কাছ থেকে বলটা অনেকটা ছিনিয়ে নিয়ে গোল করেন রজার মিলা। এটা কি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল? মিলা বলেন, ‘আমি খুবই ভাগ্যবান যে আমি কলম্বিয়ার অধিনায়ক কার্লোস ভালদেরামার সাথে মন্তপেলিয়ারে খেলেছি। আমাদের দলটা দারুণ ছিল। দলে ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার জুলিও সিজার, তরুণ লরেন্ত ব্ল্যাঙ্করা ছিল। ভালদেরামার সৌজন্যে আমার হিগুইতার ভিডিও দেখার সুযোগ হয়। আমি দেখেছিলাম, ও জায়গা ছেড়ে দিয়ে ড্রিবলিং করে। আমি জানতাম, যদি ক্ষিপ্রতার সাথে কিছু করতে পারি তাহলে ওর ভুলের সুযোগটা নিতে পারবো। বিষয়টা কাজ করে যায়।’
পরে রজার মিলার ১৯৯৪ বিশ্বকাপেও খেলেছিলেন। ৪২ বছর বয়সে গোলও করেন। সেই বিশ্বকাপটাও তিনি খেলেন ক্যামেরুনের সমর্থকদের দাবিতে। তিনি বলেন, ‘ওটা ছিল ক্যামেরুনের জনগণের দাবি। ওরাই আমাকে খেলতে বাধ্য করে। ওরা ভেবেছিল, একমাত্র আমিই গোল করতে জানি। ওদের অন্য কোনো খেলোয়াড়ের ওপর ভরসা ছিল না। তখন আমি টোন্নেরে ইয়াওন্ডের হয়ে খেলি। ফলে ফিটনেসের কোনো সমস্যা ছিল না। আর আত্মবিশ্বাস? সে আর বলতে!’
যদিও, রজার মিলার ক্যারিয়ারের হাইলাইটস বলতে সবার আগে ওই ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপই আসবে। তবে, গোটা জীবনজুড়ে সাদামাটাই থেকে গেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বিশ্বকাপ খেলার পর বুঝতে পেরেছিলাম, সমর্থকদের ওপর আমরা কতটা প্রভাব রাখতে পারি। তবে, আমি পাল্টাইনি, পাল্টেছে শুধু আমাকে ঘিরে মানুষের ধারণা। আমি একই আছে, এখনো সাদামাটা জীবন যাপনই করছি।’