রীতিমত যেন এক সিনেমার গল্প। না সিনেমা তো জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত। তাহলে হয়ত রিঙ্কু সিংয়ের জীবনটা হতে পারে কোন এক ব্যবসা সফল সিনেমার রশদ। কি নেই তাঁর গল্পে? সংগ্রাম, কষ্ট, প্রত্যাখান, হতাশা এবং শেষমেশ সফলতা। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে তিনি যেন নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। মাত্র ২৪-২৫ বছর বয়সেই যেন জীবনের সব বাঁক দেখে ফেলেছেন নতুন এই তারকা।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) বরাবরই বেশ কিছু সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের উত্থান হয়। সেই উত্থানের তালিকায় উপরের দিকেই অবস্থান সম্ভবত এই রিঙ্কু সিংয়ের। দুই বারের আইপিএল শিরোপা জয়ী কলকাতা নাইট রাইডার্সের গত কয়েকটা মৌসুমই বাজে কাটছে। সেই ধ্বংসস্তূপে যেন আশার প্রদীপ জ্বেলে উদয় হলেন এই রিঙ্কু সিং।
নিরাশার মাঝেও নতুন এক আশার নাম যেন রিঙ্কু সিং। ইতোমধ্যেই রিঙ্কু সিং তাঁর সম্ভাবনার ঝলক দেখিয়ে ফেলেছেন। গত মৌসুমে তাঁর ক্যামিও ইনিংসগুলো খুব মনে ধরেছিল কলকাতা সমর্থক থেকে শুরু করে কর্তাদের।
তবে, এবার তিনি যা করলেন তা রীতিমত বিস্ময়। না হলে কি আর নয় বলে ৪০ রান তাড়া করা যায়। যদিও, রিঙ্কু সিংয়ের গল্পের শুরুটা এখান থেকেই নয়। সেই গল্পটাই এবার শুনি চলুন।
অতি সাধারণ এক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন তিনি। আলিগড়ে জন্ম তাঁর। হতদরিদ্র বাবার ছেলে। ক্রিকেটকে ভালবেসে ফেলেছিল। আর সে প্রেম থেকে যেন উঠবারই নাম নেই। তবে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবে স্থান হয়েছিল রিঙ্কুর। ২০১৭ সালে সবাই হয়ত ভেবেছিল রিঙ্কুর অন্তত তাঁর বাবার মুখ উজ্জ্বল করবেন। তবে না সে সুযোগটা আর পাওয়া হয় না।
পাঞ্জাবের হয়ে বেঞ্চে বসেই কাটিয়ে দেন তিনি। তবে এর পরের বছর নিলাম থেকে তাঁকে কিনে নেয় কলকাতা নাইট রাইডার্স। খরচ করে ৮০ লাখ রুপি। তবে নাইটদের হয়েও নিজেকে প্রমাণের মঞ্চ খুব একটা যেন মিলছিলই না। যেটুকুনও মিলেছিল তাও যেন পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেননি রিঙ্কু। সে জন্য তাঁকে নিয়ে কত সমালোচনা। তবে রিঙ্কু যেন অপেক্ষা করছিলেন হিরো হবার।
তিনি এমন কোন একটা খারাপ সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন, যখন মধ্যমণি হয়ে মাঝে মধ্যেই দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাবেন। সেটাই যেন হয়ে গেল আইপিএলে পঞ্চদশ আসর। তবে গত আসরেও কলকাতা নাইট রাইডার্স তাঁকে দলে নেওয়ায় সমালোচনা কম হয়নি। ৫৫ লাখ টাকাও যেন জলে গেছে কলকাতার এমনটাই মত ছিল সবার।
তবে, সে মতের বিপরীতে গিয়ে কি করে সবার প্রশংসার পাত্র হতে হয় তা রপ্ত করা শেষ রিঙ্কুর। সেই ধারাবাহিকতা থাকল এবারও, এবার তিনি যেন আরও প্রকাণ্ড। শেষ পাঁচ বলে পাঁচটা ছক্কা, ৩১ রানের বিশাল ওভার। বলতেই হয় যে, রিঙ্কু সিং হারিয়ে যেতে আসেননি।
তবে এর আগে ইনজুরির সাথে লড়াই করার সাথে সাথে বঞ্চনার সাথেও লড়াই করে গেছেন রিঙ্কু। তাঁর পরিবারের এমন অবস্থা যে তাঁরা বাবা রীতিমত খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন রিঙ্কুর ইনজুরির কথা শুনে।
রিঙ্কু বলেন, ‘ক্রিকেট থেকে দূরে থাকায় আমার তেমন ভাল লাগছিল না। আমার বাবা ২-৩দিন কোন খাবার খায়নি আমি তাঁকে বুঝিয়েছি যে এটা সামান্য একটা ইনজুরি এটা ক্রিকেটেরই অংশ। আমি আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তাই যখন এমন কিছু হয় তখন তা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
রিঙ্কুর পরিবারে তিনি একাই উপার্জন করেন। এই একটা বাক্যে বোঝা যায় তিনি ঠিক কতটা চাপ নিয়ে নিজেকে প্রমাণের জন্য নেমেছিলেন এবারের আইপিএলে। এর আগে অবশ্য উত্তর প্রদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সফলতার দেখা পেয়েছিলেন তরুণ এই ক্রিকেটার। এরপরই যেন নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করেন। তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন যে গেল মৌসুমে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন হাতে ‘৫০’ লিখে।
আর সে ম্যাচেই তিনি করেছিলেন ২৩ বলে ৪৩ রান, ছিলেন অপরাজিত। ঠিক কতটা আত্মবিশ্বাসী হলে এমন কাজ করা যায়। এই আত্মবিশ্বাসের জন্য অবশ্য কলকাতা ফ্রাঞ্চাইজির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই পারেন রিঙ্কু। কেননা কলকাতা তাঁর উপর ভরসা রেখে তাঁকে আবার দলের ভিড়িয়েছে। তবে তাঁর প্রতিদানও যে একেবারেই দিচ্ছেন না রিঙ্কু বিষয়টা তেমনও নয়।
আর এবার তো মাত্র শুরু হল আসর। গেল মৌসুমটায় রিঙ্কু দিয়েছিলেন ট্রলের জবাব। আর এই আইপিএলটা যেন তাঁর জন্য কিংবদন্তি হওয়ার মিশন। রাস্তাটা কঠিন, কিন্তু কঠিন কে কি আর কেয়ার করতে জানেন রিঙ্কু!
রিঙ্কু নিজের এই অবস্থান নিজ হাতে গড়ে নিয়েছেন। নিজের একাগ্রতা আর আত্মবিশ্বাসী মনোভাব দিয়ে। তাঁর হার না মানা অদম্য শক্তির তাঁকে আজ বানিয়েছে চর্চার বিষয়। তাঁর ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা নিশচয়ই অনেকটা দূর নিয়ে যাবে তাঁকে।