এসি মিলান, ইউরোপিয়ান ফুটবলের ইতিহাসের পাতায় ঘুরতে গেলে শুরুর দিকেই চোখে পড়বে দলটির নাম। জন্মলগ্ন থেকে ইতালিয়ান ক্লাবটি দাপিয়ে বেড়িয়েছে ঘরে, বাইরে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ম্লান হয়ে গিয়েছে রোজারিও-দের পারফরম্যান্স। সর্বশেষ কবে লিগ শিরোপা জিততে দেখেছেন ক্লাবটিকে?
সহসা মনে পড়ার কথা নয়। কারণ, দীর্ঘ প্রায় যুগ আগে, কাগজে কলমে এগারো বছর আগে সর্বশেষ সিরি-এ এর ট্রফিতে হাত রেখেছিল এসি মিলান। অবশ্য এমন ট্রফি শূন্যতার সময় আর লম্বা করে নি ইতালির জায়ান্টরা, ২০২১/২২ মৌসুমে লিগ জেতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ এগারো বছরের শিরোপা-খরা কাটিয়েছে দলটি।
নিজের ক্যারিয়ারের শেষদিকে পুনরায় ইতালিতে ফেরা জ্লাতান অবশ্য আগেই কথা দিয়েছিলেন ইতালিয়ান রেড এন্ড হোয়াইটদের একটা শিরোপা না জিতিয়ে অবসর নিবেন না। এবারের লিগে ২২ ম্যাচে ৮ গোল আর তিন অ্যাসিস্ট করে লিগ জয়ে অবদান রাখার মধ্য দিয়ে নিজের কথা রেখেছেন এই বর্ষীয়ান ফুটবলার।
সদ্যসমাপ্ত লিগের শেষ ম্যাচ খেলতে নামার আগেই পয়েন্ট টেবিলের উপরে ছিল এসি মিলান। আর দুই পয়েন্টের ব্যবধানে পরের স্থানে ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টার মিলান। তাই জয় এড়াতে পারলেই লিগে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারবে এসি মিলান, এমন সমীকরণকে সামনে রেখে শেষ ম্যাচ খেলতে নামে তাঁরা।
ম্যাপেই স্টেডিয়ামে এদিন এসি মিলানকে আতিথেয়তা দিয়েছিল টেবিলের এগারো নম্বরের দল সাসুলৌ। অলিভার জিরুদের জোড়া গোলে স্বাগতিকদের হারাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাদের। জিরুদের পাশাপাশি ফ্র্যাঙ্ক কেসি মিলানের হয়ে করেছেন একটি গোল।
এই জয়ে সবমিলিয়ে মৌসুমে ৩৮ ম্যাচ খেলা এসি মিলানের সংগ্রহ ৮৬ পয়েন্ট। অন্যদিকে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টার মিলান ৮৪ পয়েন্ট নিয়ে লিগে দ্বিতীয় হয়েছে। আর এসি মিলান দীর্ঘ সময় পর হাতে পেয়েছে লিগ শিরোপা। ক্লাব ইতিহাসের ১৯তম সিরি এ জিতেছে দলটি।
২০১১/১২ মৌসুমে এসি মিলান সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরের ৯ বছর জুভেন্টাসের একক আধিপত্য ছিল ইতালিতে। তাদের দাপটের অবসান ঘটিয়ে গত বছর ইন্টার মিলানের হাতে উঠেছিল ইতালিয়ান মুকুট। আন্তোনিও কন্তের হাত ধরে ২০১০ সালের পর প্রথম লিগ শিরোপা জিতেছিল ইন্টার। গত বছর ইন্টারের ১১ বছরের অপেক্ষা ঘুচেছে, এবার এসি মিলানের ১১ বছরের অপেক্ষাও শেষ হয়েছে।
মিলানের মতো ক্লাবের জন্য ১১ বছর দীর্ঘ অপেক্ষা একটু বেশিই বটে। এই সময়ের মধ্যে মিলানে বারবার পরিবর্তন ঘটেছে। বদল হয়েছে ক্লাবের খেলোয়াড়, কোচ এমনকি ক্লাবের মালিকানাও। এমন অস্থির পরিবর্তনগুলো মাঠের ভেতর এবং বাইরে মিলানকে প্রভাবিত করেছে।
২০১০-১১ সালে মিলানের লিগ জয় ছিল একটি নিখুঁত পথচলা। কোচ হিসাবে ছিলেন ম্যাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি। খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন আলেসান্দ্রো নেস্তা, আলেকসান্দ্রে পাতো, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, থিয়াগো সিলভা, ক্লারেন্স সিডর্ফের মত বিশ্বমানের তারকারা। যারা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মজবুত করছিলেন এসি মিলান দলটিকে।
সেই মিলান দলটি স্বভাবতই নিজেদের সময়ের অন্যতম পরাশক্তি ছিল। অথচ এরপরই ছন্দপতন ঘটে দলে। ট্রান্সফারে দল ছাড়েন সিলভা, জ্লাতানরা। অন্যদিকে বুটজোড়া তুলে রাখেন নেস্তা, সিডর্ফের মত কিংবদন্তিরা। সবমিলিয়ে অগোছালো হয়ে পড়ে রোজারিওরা। কিন্তু হাল ছাড়েনি, বারবার চেষ্টা করেছে গুছিয়ে উঠতে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর কোচের দায়িত্ব দেয়া হয় স্টেফানো পিওলিকে।
তার দীক্ষাতেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এসি মিলান। গত মৌসুমে অবশ্য রানার আপ হয়েছিল। আর এবার একেবারে শিরোপা মঞ্চে উঠে এসেছে দলটি। সর্বশেষ স্পেজিয়া’র বিপক্ষে হারার পর থেকেই লিগে অপরাজিত এসি মিলান। দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা, দৃঢ় মনোবল, দলীয় বন্ধনের জোরেই এমন অর্জন সম্ভব হয়েছে তাদের।
তারপরও প্রশ্ন থাকতে পারে ভাঙ্গাচোরা একটি আক্রমন ভাগ নিয়ে কিভাবে এতদূর এগিয়ে গেলো। বুড়ো জ্লাতান, অফ ফর্মে থাকা জিরুদ আর অনভিজ্ঞ উইঙ্গারদের নিয়েই অসম্ভব কীর্তি গড়েছেন পিওলি। অবশ্য ডিফেন্স এবং মিডফিল্ড থেকে যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছে তাঁরা। বিশেষ করে থিও হার্নান্দেজ, ফ্র্যাঙ্ক কেসির মত সদস্যরা নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন মাঠে।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ আর ইতালিয়ান সিরি এ একইসাথে শেষ হয়েছে। অথচ ম্যানসিটি’র জয়ে যতটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে ততটা হয়তো উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি এসি মিলানের অর্জনে। ইতালিয়ান ফুটবলের অনুরাগীদের তাতে একটু রাগ হতেই পারে। তবে শেষ পর্যন্ত তুরিনের ওল্ড লেডিদের আধিপত্য শেষে, ঘরোয়া লিগে লড়াইটা হচ্ছে সমানে-সমানে – এমনটা ভেবে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতেই পারেন তাঁরা।