এনামুল হক বিজয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিচিত্র একটা অধ্যায়। সেই যুব পর্যায়ের ক্রিকেট থেকেই তাঁর রান করার সক্ষমতা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই নিজের প্রতিভার জানান তিনি দিয়েই এসেছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর শুরুটাও ছিল বিরাট জমকালো। প্রথম তিন ওয়ানডের মধ্যেই একটা চল্লিশোর্ধ্ব রানের ইনিংস আরেকটা সেঞ্চুরি করে তাঁক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এমন একজন ধারাবাহিক ব্যাটার পাওয়া বাংলাদেশের জন্য রীতিমত স্বপ্নের মত একটা ব্যাপার ছিল।
৫০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে দ্রুততম সময়ে এক হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছান তিনি। ২৯ টি ইনিংস নিয়ে সেখানে তাঁর সঙ্গী আছেন সাবেক ওপেনার শাহরিয়ার নাফিসও। এই এক হাজার রান করতে তিনটা সেঞ্চুরি করেন বিজয়। তিনটাই কোয়ালিটি বোলিং ইউনিটের বিপক্ষে। কিন্তু, সমস্যা হল – তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা ওই এক হাজার রানেই থমকে আছে।
এখানে প্রথম দায়টা তাঁর নিজেরই। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ চলাকালে ইনজুরি ও শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত কারণে তিনি দল থেকে জায়গা হারান। সেখান থেকে শুরু করে এখন অবধি খেলেছেন মাত্র আটটা ওয়ানডে। এর মধ্যে সাতটাই ২০১৮ সালে। আর একটা ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালে তিনি সাতটা ওয়ানডের একটাতেও কোনো হাফ সেঞ্চুরির দেখা পাননি। এর এক বছর পর হঠাৎ করে তাঁকে দলে এনে এক ম্যাচের পর আর সুযোগই দেওয়া হল না।
ঘরোয়া ক্রিকেটে বড় একট সময় অফ ফর্মে ভুগেছেন বিজয়। তিনি ব্যাট হ্যাতে এমন কোনো পারফরম্যান্স করে দেখাতে পারেননি যা তাঁর দলে ফেরার পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর জাতীয় দলে শেষ ক’টা দিন তাঁর ধুঁকে ধুঁকে শুরু করা ব্যাটিং, ফুটওয়ার্ক নিয়ে সমালোচনা ছিল। প্রয়োজন বুঝে রানের স্ট্রাইক রেট বাড়িয়ে নেওয়ায় পক্ত হতে পারেননি। সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল দলের প্রতি তাঁর নিবেদন নিয়ে।
তাই, বাকিদের চেয়ে তাঁর অপেক্ষার প্রহরটা একটু বেশিই লম্বা হল। এই অচলায়তন ভাঙতে বিরাট কিছু করার দরকার ছিল বিজয়ের। বিজয় সেটা করতে পেরেছেন বিজয়ী বীরের মতই। সর্বশেষ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ২৮০ রান করেন তিনি সিলেট সানরাইজার্সের জার্সি পরে নয় ম্যাচ খেলে। স্ট্রাইক রেট ছিল ১২১.৭৩। তখন থেকেই তাঁকে আলোচনার শুরু। বিজয়কে ফেরানো দরকার, বিজয়কে ফেরানো উচিৎ – ইত্যাদি রব শোনা যাচ্ছিল।
বিজয় ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে পারফরম করে আলোচনার আগুনে নতুন করে ঘিঁ ঢাললেন। তিনি লিস্ট ‘এ’ স্বীকৃত পাওয়ার পর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসের প্রথম ব্যাটার হিসেবে এক হাজার রানের ওপর করলেন এক মৌসুমে। প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতে নেমে ১৫ ম্যাচে তিনি করেন ১১৩৮ রান। তাতে ছিল তিনটি সেঞ্চুরি ও নয়টি হাফ সেঞ্চুরি। ব্যাটিং গড় ৮১.২৮। স্ট্রাইক রেট ৯৮.৬১। এরপরও তাঁকে ওয়ানডে দলে না ফেরালে সেটা তাঁর প্রতি অবিচারই হত।
ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দুই ফরম্যাটের দলেই ফিরেছেন তিনি। তিন বছর পর ওয়ানডে দল আর সাত বছর পর টি-টোয়েন্টি দলে ফিরলেন বিজয়। যাবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। আসলে এখান থেকে বিজয়ের আসল লড়াইটা শুরু হবে। শুরু হবে আসল পরীক্ষা।
কারণ, ঘরোয়া ক্রিকেটে আমাদের ব্যাটাররা যেমন বোলিংয়ের বিপক্ষে কিংবা যেমন উইকেট খেলে – সেটা ঠিক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মেলে না। ফলে, বিজয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজে যে কোনো গোলাপ শয্যা অপেক্ষা করছে না – সেটা চোখ বুজে বলা যায়।
আবার একই সাথে এটাও ঠিক যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বোচ্চ যে পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করা সম্ভব সেটা বিজয় করেছেন। আর দলে তাঁকে নেওয়ার জায়গাও আছে। সেই ফাঁকা জায়গায় বিজয় স্রেফ পরে থাকবেন নাকি শূণ্যস্থান পূরণ করে একটা সেতুবন্ধন রচনা করবেন – সেই সিদ্ধান্তটা তাঁকেই নিতে হবে। ফুটওয়ার্ক আর দলের প্রতি নিবেদনজনিত সংকটটা যদি সত্যিই কেটে গিয়ে থাকে তাহলে বিজয়ের নিশান আকাশেই ওড়ার কথা।