পাল্টা আক্রমণের দুই সারথী

১৯৫৯ সাল। তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়াম, মানে এখনকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ২২ রানে ৫ উইকেট হারায় পাকিস্তান। সেখান থেকে ১৪৫ রানে শেষ হয় পাকিস্তানের ইনিংস। বাংলাদেশের সামনেও এবারের ঢাকা টেস্টে এমন কিছুই চোখ রাঙাচ্ছিল। মাত্র ২৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে ছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে মুশফিকুর রহিম ও লিটন দাসের দুর্দান্ত জুটিতে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। দিনের শুরুতে মুখ থুবড়ে পড়া বাংলাদেশ – দিনের শেষে শক্ত অবস্থানে।

সেদিন ওয়ালিস মাথিয়াস ও সুজাউদ্দিনের ব্যাটে বিপর্যয় থেকে উঠে দাঁড়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবুও বেশিদূর যেতে পারেনি ক্যারিবীয়রা। ১৪৫ রানেই থামতে হয়েছে পাকিস্তানের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে। বাংলাদেশের দুই তারকাকে অবশ্য দমাতে পারেনি লঙ্কান বোলাররা।

সেই ম্যাচে পাকিস্তান দুই ইনিংসে ১৪৫ ও ১৪৪ করলেও পেসার ফজল মাহমুদ দুই ইনিংসে ১২ উইকেট শিকার করে ধসিয়ে দিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। তবে ঢাকা টেস্টে মাত্র প্রথম দিন শেষ হয়েছে। এর মধ্যে দুই টেস্টে বড় পার্থক্য ষষ্ঠ উইকেটে মুশফিক-লিটনের দুইশোর বেশি রানের অবিশ্বাস্য এক জুটি।

তবে লিটন-মুশফিক এই কাতারে পড়বেন না। একজন বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটারদের একজন। যিনি গেল টেস্টেই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে ৫ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। আরেকজন বর্তমান সময়ে টেস্টের অন্যতম সেরা ব্যাটার; গেল ছয় মাসে যিনি তিন সেঞ্চুরি করেছেন। এই সময়ে ওয়ানডে ও টেস্টে – দুই ফরম্যাটেই পঞ্চাশের বেশি গড়ে রান করেছেন তিনি।

তবে সাম্প্রতিক ফর্ম বিবেচনায় লিটনের ব্যাটিং পজিশন খানিকটা নিচেই বলা চলে। এই ফর্ম নিয়ে লিটনকে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন আপের ইঞ্জিন রুমের দায়িত্বেই রাখা উচিত; মিডল অর্ডারে আরেকটু উপরের দিকে। সাত ওভারেই বাংলাদেশের অর্ধেক ব্যাটার যখন প্যাভিলিয়নে – তখনো সমর্থকদের বিশ্বাস ছিল এ’দুজনের ব্যাটে ঘুরে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশ।

আসিথা ফার্নান্দো ও কাসুন রাজিথার বোলিং দাপটে মাত্র ২৪ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং শিবির। তরুণ মাহমুদুল হাসান জয় শেষ চার ইনিংসের তিনটিতেই ডাক। তামিম ইকবালও ফিরেছেন শূন্য হাতে, ফর্ম হারিয়ে ধুঁকছিলেন মুমিনুল। রান খরার ধারাবাহিকতা ধরে রাখলেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক। শান্ত-মুশফিকের উপর দায়িত্বটা ছিল; তবে শান্ত ফিরে গেলেন একই ভাবে। পরের বলে শূন্য রানেই শেষ সাকিবও। মূহুর্তেই যেন ধসে পড়লো বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ।

চট্রগ্রাম টেস্টটা একটু ব্যতিক্রম ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেও শেষ টেস্টে ৫৩ ও ৮০ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। এই ঢাকার মিরপুরেই বৃষ্টিতে অর্ধেক খেলা ভেস্তে গেলেও মাত্র আড়াই দিনেই পাকিস্তানের কাছে হেরে যায় মুমিনুল হকের দল।

অবশ্য বাংলাদেশের প্রধান কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো এখান থেকে ইতিবাচক দিকগুলোই নিতে চান। তিনি কোচিং ক্যারিয়ারে এমন ধসে পরে এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে দেখেননি বলেই মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘ টেস্টে আমার কোচিং ক্যারিয়ারে এটি অন্যতম সেরা জুটি দেখেছি। আমরা মাত্র ২৪ রানে ৫ উইকেট হারাই। এই চাপের মুখে দুই ব্যাটারের দুর্দান্ত এক জুটি ছিল। আমরা সকালে ভাল শুরু করতে পারিনি। ভুল শট ছিল কিছু। কিছু ভাল ডেলিভারি ছিল। টেস্ট ক্রিকেট কঠিন; তবে এই দুই ব্যাটার আমাদেরকে নিজেদের সামর্থ্য দেখিয়ে ভাল পজিশনে এনে দিয়েছে। ‘

বাংলাদেশের বেশ কিছু ঘুরে দাঁড়ানোর ইনিংসে মুশফিকের অবদান অনেক। তাও এমন সমালোচনার মাঝে নিজের লক্ষ্য ঠিক রেখে সেরাটা দেওয়া। ডোমিঙ্গো বলেছেন, ‘মুশফিক সবচেয়ে বেশি বল খেলেছে। তাঁর ভাল করার ইচ্ছেটা সবসময় থাকে। আমার মনে হয় যখন কারো সময়টা ভাল যায় না তখন সে সবার ভালবাসা, সমর্থন চায়। শেষ কয়েক ম্যাচ ধরে মুশি নিজের ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে কাজ করছে। সে জানে কিভাবে রান করতে হবে।’

লিটনের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী রাসেল ডোমিঙ্গো। তিনি বলেন, ‘তার ব্যাটিং টেকনিক বেশ ভাল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত দেড় বছর ধরে সে নিজেকে টেস্টের জন্য তৈরি করছে। সে ভাল একটা রুটিন তৈরি করেছে। সে নিজের খেলাটাকে ভিন্ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আমার মনে হয় লোয়ার অর্ডার তাকে সেটা দিয়েছে। সে অবশ্যই চার-পাঁচে খেলবে সামনে। ছয়-সাতে চাপ থাকে না, সে নিজের মত করে খেলতে পারে।’

২০২২ সালে বাংলাদেশ বেশ কিছু দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন করেছে। নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতে হারানো, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ব্যাটিং ধসের পর জয় পাওয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয়। ঢাকা টেস্টেও এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। কে জানে! হয়ত আরেকটি দুর্দান্ত জয় হাতছানি দিচ্ছে বাংলাদেশের সামনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link