বর্ণাঢ্য নয় তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার। কিন্তু কেন জানি আশির দশকের শেষ থেকে নব্বই দশকের ক্রিকেট দর্শকদের একটা মত, স্নেহাশিস গাঙ্গুলি নাকি ছিলেন তাঁর ভাইয়ের থেকেও বেশ প্রতিভাবান। তবে স্নেহাশিসের কপালে জোটেনি ভারতের জাতীয় দলের জার্সি। তবুও এমন মন্তব্য। যা কিছু রটে তাঁর কিছুটা নিশ্চয়ই ঘটে।
স্নেহাশিসের ক্যারিয়ারটা সময় মেনে, ক্রমশ সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে। বেহালার বনেদী পরিবারে জন্ম তাঁর। ১১ জুন ১৯৬৫ সালে। পারিবারিক এক ব্যবসা ছিল তাঁদের। প্রিন্টিংয়ের সে ব্যবসায় তিনি জড়িয়েছিলেন তা বেশ বহু পরে। তার আগে তিনি ক্রিকেটের ময়দানটাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, বাবার ফেলে আসা পথ ধরে। বাবাও তো ছিলেন ক্রিকেট মাঠের প্রতাপশালী।
চণ্ডি গাঙ্গুলি ক্রিকেটার হিসেবে ময়দানে দাপিয়ে বেড়ানো ছাড়াও ছিলেন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের সচিব। তাই বলে যে বাড়তি সুযোগ পেয়েছিল তাঁর ছেলেরা, সে কথা বলার খুব বেশি উপায় নেই। পদে পদে নিজেদের প্রমাণ করেই স্নেহাশিস ও সৌরভ গাঙ্গুলি খেলেছেন বাংলার রঞ্জি দলে। পনেরো বছরের কোটা পেরুণোর আগেই প্রতিযোগিতার মহামঞ্চে নেমে পড়েন স্নেহাশিস।
এরপর ক্রমাগত বাংলার বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলতে থাকেন। প্রতিভাবান বলেই তিনি সেটা করে গেছেন এমনটাই মত। রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর পারফরমেন্স অন্তত প্রতিভার পক্ষেই কথা বলে। আবার সে সাথে একটা জেদ তো নিশ্চয়ই ছিল। বাবার ছায়াতল থেকে বেড়িয়ে আসার। স্নেহাশিস সেটা পেরেছিলেন। অনেকটা পথ ঘুড়ে ১৯৮৭ সালে প্রথমবারের মত তিনি ডাক পান বাংলার রঞ্জি দলে।
অভিষেকটা হয়েছিল বিহারের বিপক্ষে। প্রত্যাশার চাপে একেবারে নুইয়ে পড়েননি স্নেহাশিস। তিনি বরং বুক চিতিয়ে লড়াই করে, করেছিলেন আশা জাগানিয়া ৫৭। প্রত্যাশার আলো তখনও উজ্জ্বল। বাকি পথটায় শুধু জ্বালানির জোগান দিতে হত স্নেহাশিসকে। কাজটা ভাল করেই জানা ছিল তাঁর। তবে সময় নিয়েছেন। সময় নিয়ে হয়েছেন দলের আস্থাভাজন।
পরের মৌসুমে তিনি তাঁর প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটের প্রথম শতকের দেখা পান। আসামের বিপক্ষে সেবার ১০৭ রান করেছিলেন তিনি। কাকতালীয়ভাবে পরের মৌসুমে আবার শতক। প্রতিপক্ষ সেই আসাম। সেই মৌসুমে অর্থাৎ ১৯৮৮-৮৯ সালে বাংলা উঠেছিল ফাইনালে। সেমিফাইনালে ৮১ রানের এক দুরন্ত ইনিংস খেলেছিলেন স্নেহাশিস। দুর্ভাগ্যের বিষয় ফাইনালে ব্যাট হাসেনি তাঁর, শিরোপাও জয় করা হয়নি বাংলার।
তবে পরের বছর শিরোপা ঠিকই জয় করে নিয়েছিল বাংলা। কলকাতার মাটিতে দিল্লিকে হারিয়ে। আগের মৌসুমের একটা প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যায়। তবে স্নেহাশিস নিশ্চয়ই মাঠের বাইরে বসে মিশ্র এক অনুভূতিতে মেতেছিলেন সেদিন। কলকাতার ফাইনালটা খেলা হয়ে ওঠেনি স্নেহাশিসের। তাঁর বদলে খেলতে নেমেছিল তাঁরই ছোটভাই সৌরভ গাঙ্গুলি। নিজের কথা ভুলে নিশ্চয়ই ফাইনালের দিনে ভাই ও দলের জন্য আনন্দে মেতেছিলেন স্নেহাশীষ।
সেবারের ফাইনাল খেলার আক্ষেপটা তিনি যেন মেটালেন ১৯৯০-৯১ মৌসুমে। নিজের ক্যারিয়ারে একটু আলাদা করার মত এক রুপকথার ইনিংস দিয়ে। সেবার রান/ওভারের মারপ্যাঁচে বাংলার ছিটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে ওই যে জেদ। কিছু একটা করে দেখবার। স্নেহাশীষের মাথায় তখন সে জেদটাই আবার হয়েছিল সরব। একা হাতে এক পাশ সামলে রেখেছিলেন তিনি।
শেষ উইকেট জুটিতে জড়ো করেছিলেন ৭৭ রান। তাও আবার সাগরময় সেনশর্মার মত এক ব্যাটারকে সাথে নিয়ে। যিনি কি না পুরোদস্তুর একজন পেসার। ব্যাটিং গড়টা ৯.৭৩। কঠিন এক ম্যাচ তিনি বাঁচিয়েছিলেন। ১১৬ রান করেছিলেন। সেই সাথে সেমিফাইনালে তুলেছিলেন বাংলাকে। পায়ের পেশির টান, অপরপ্রান্তে উইকেট তাসের ঘর। এসব কিছু সামলে স্নেহাশীষ খেলে গিয়েছিলেন বাঁধাহীনভাবে।
এমন সব ইনিংস তিনি খেলেছিলেন নিয়ম করেই। হাল ধরেছিলেন বহুবার। তবে কেন জানি ভারত দলের হাল ধরার সুযোগটা হয়ে ওঠেনি তাঁর। তিনি যেন রয়ে গেলেন বাংলার ‘রাজ’ হয়েই। ভারত জাতীয় দলে খেলতে পারার আক্ষেপটা এখনও নিশ্চয়ই পোড়ায় তাকে। আলাপ, আলোচনা আর গুঞ্জনের শেষ নেই ভারতের জার্সি গায়ে জড়াতে পারেননি তা নিয়ে। তবে কিছু গল্প বোধহয় আড়ালে থেকে গেলেই মঙ্গল।