এক বল, প্রয়োজন পাঁচ রানের।
স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো নিদাহাস ট্রফির সেই রোমাঞ্চকর ফাইনাল। বাংলাদেশের বিপক্ষে ফাইনালে শিরোপা জিততে শেষ বলে ভারতের প্রয়োজন ছিল পাঁচ রানের। সৌম্য সরকারের করা অফ স্টাম্পের বাইরের ফুলার লেন্থের বল সজোরে কাভারের উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকান দীনেশ কার্তিক। শ্বাসরুদ্ধকর শেষ বলে ভারতের স্মরণীয় এক ফাইনাল জয়।
এরপর কেটে গেল প্রায় চার বছর। সেই কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামেই আরও এক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচের সমাপ্তির অপেক্ষায় ক্রিকেটপ্রেমীরা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শেষ বলে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ৫ রানের। সৌম্যর জায়গায় এবার বল হাতে লঙ্কান অধিনায়ক দাসুন শানাকা, আর ব্যাট হাতে স্ট্রাইকে তরুণ ম্যাথু কুহনেমান। পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে লঙ্কান সমর্থকদের উৎকণ্ঠা আর চোখজুড়ে জয়ের তীব্র বাসনা। এই একটা জয় যে পালটে দিতে পারে অনেক কিছুই!
চার বছর আগের নিদাহাস ট্রফির মতো ঠিক একই পরিস্থিতি, ম্যাচে একই চিত্র ফুটে উঠলো; তবে, এবার ফলাফলটা ভিন্ন। বাংলাদেশের মত জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয়নি লঙ্কানদের। শানাকার শেষ বলটা উড়িয়ে মারতে গিয়ে ইনার সার্কেলের ভিতরেই আসালাঙ্কার হাতে ধরা পড়েন কুহনেম্যান। ঘরের মাটিতে শ্বাসরুদ্ধকর এক লড়াইয়ে শেষ বলে দলকে দুর্দান্ত এক জয় এনে দেন শানাকা।
একটা রোমাঞ্চকর লড়াই, শ্বাসরুদ্ধকর শেষ ওভার, অসাধারণ এক জয় আর রেকর্ড। প্রথম ম্যাচে হারের পর টানা তিন জয়ে অজিদের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক সিরিজ জয় লঙ্কানদের। অপেক্ষাটাও দীর্ঘ সময়ের। ক্যালেন্ডারের পাতায় প্রায় ৩০ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাটিতে সিরিজ জয়!
সেই ১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাটিতে সবশেষ সিরিজ জয়। এরপর ঘরের মাটিতে যতবারই দেখা হয়েছে – লঙ্কানদের হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করেছে অজিরা। সিংহের ডেরায় প্রায় ত্রিশ বছর ধরে শাসন করে এসেছে অজিরা – সেটার ইতি ঘটলো এই সিরিজ দিয়ে।
২১ জুন তারিখটা অবশ্য লঙ্কানদের স্বপ্নভঙ্গের বিষাদময় একটা দিন। ২০০৯ সালের এই দিনেই পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে টি-টোয়েন্টি শিরোপা জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয় লঙ্কানদের। ২১ জুন – লঙ্কানদের ইতিহাসে যেমন আছে হতাশা আর আক্ষেপের বিশ্বকাপ ফাইনাল, তেমনি বেশকিছু সুখস্মৃতিও আছে।
১৯৯৮ সালের এই দিনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে জয় পেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। এরপর ২০১৬ ও ২০১৯ সালের এই দিনেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও দুর্দান্ত পারফরম করে লঙ্কানরা। ২০১৬ সালে টাই ও ২০১৯ সালে জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছিল লঙ্কানরা। ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংলিশদের বিপক্ষে এই দিনেই দুর্দান্ত এক জয়ের দেখা পেয়েছিল লঙ্কাবাহিনী।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ঋণের চাপে মুখ থুবড়ে পড়া লঙ্কানদের অবস্থা এখন চরম ভয়াবহ। দেশটার ভবিষ্যত এখন নিকশ কালো অন্ধকারে আচ্ছন্ন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দেশটায় এখন জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লড়ছে সাধারণ মানুষ। একসময় ২২ গজে দাপটে সেই লঙ্কান দলটাও আর নেই।
প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা সনাথ জয়াসুরিয়া, মুত্তিয়া মুরালিধরণ, মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, তিলেকারত্নে দিলশান, লাসিথ মালিঙ্গাদের মত বিশ্বসেরা তারকাদের সেই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটও এখন পঙ্গুপ্রায় অবস্থায়। ঘরের মাটিতেও প্রতিপক্ষের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণের চিত্রটাও হরহামেশাই দেখা মিলছিল।
সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো, কিছু তরুণ প্রতিভা আর সম্ভাবনাময় তারকাদের নিয়ে ফের লড়াইয়ের শুরু। দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত যেখানে অনিশ্চিয়তায় ঘেরা, সংকটময় এক অবস্থায় পুরো দেশ – সেখানে এই জয়টা নি:সন্দেহে লঙ্কানদের জন্য ক্ষনিকের আনন্দ যোগ করবে।
টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারের পর প্রথম ওয়ানডেতেও হেরে ব্যাকফুটে ছিল লঙ্কানরা। সিরিজ জয় পাওয়াটা যেন একপ্রকার দিবাস্বপ্নের মতই ছিল লঙ্কানদের জন্য। এরপরই পালটে গেল পুরো চিত্র। তরুণ লঙ্কান তারকাদের দাপটে পাত্তা মিলেনি অজিদের। আগের ম্যাচে পাথুম নিসাঙ্কার প্রথম সেঞ্চুরি, পরের ম্যাচে চারিথ আসালাঙ্কার প্রথম সেঞ্চুরি – লঙ্কানদের ঘুরে দাঁড়ানো। প্রথম টি-টোয়েন্টি বাদে পুরো সিরিজেই অজিদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছে শ্রীলঙ্কা।
অবাক করা ব্যাপার হল, সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডেতে ছয় জন স্পিনার খেলিয়েছে শ্রীলঙ্কা। ৫০ ওভারের ইনিংসে ৪৩ ওভার বল করেছে লঙ্কান স্পিনাররা। ওয়ানডে ইতিহাস এমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে দশবার। অবশ্য লঙ্কানদের জন্য এটা বেশ স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কারণ এই দশবারের আটবারই এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে শ্রীলঙ্কা। আরেকটা অবাক করা ব্যাপার হল, এই আটবারের পাঁচবারই ভেন্যু ছিল কলম্বোর এই প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম!
একসময় ২২ গজ দাপিয়ে বেড়ানো শক্তিশালী সেই শ্রীলঙ্কা হারিয়ে গেছে ঠিক। তবে, ভঙ্গুরপ্রায় অবস্থা ঘুরে দাঁড়ানো – শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের জন্য নিশ্চিত আশার আলো। পুরনো বিষাদ ব্যাথা ভুলে এই তরুণ তারকাদের হাত ধরে হয়তো শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের নবজাগরণের সূচনা।