এস্তোরিল, পর্তুগিজ প্রতিভার আঁতুড়ঘর

স্পোর্টিং, বেনফিকার পর এবার এস্তোরিলের বাজিমাত। ৮ হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়ামের পর্তুগালের এই ক্লাবটি প্রতিভাবানদের গড়ার জন্য এখন পর্তুগালের সবচেয়ে ধনী ক্লাব হিসেবে পরিচিত।

যুগ যুগ ধরে এস্তোরিলের পর্তুগিজ রিভেইরা শহর ছিল বিত্তবান, হলিউড তারকা ও বিদেশী পর্যটকদের খেলার জায়গা। বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় রাজা ও রানীরা টেলিভিশন তারকা ওরসন ওয়েলস, জিনা ললোব্রিগিডা ও ডেম মার্গট ফন্টেনের মত কিংবদন্তিদের সাথে সমুদ্রের  পাশের হোটেলগুলিতে আড্ডায় মেতে উঠতেন। এই রাস্তাগুলোতে এখনও ধনী ব্যক্তিদের আনাগোনা হয়। এখনও যেন এই রাস্তা কিংবা সৈকতগুলো স্রেফ ধনীদের জন্যই সাজানো।

রাজধানী লিসবন থেকে ১৫ মাইলের কম দূরত্বে পর্তগালের দুই জনপ্রিয় ক্লাব স্পোর্টিং সিপি ও বেনফিকার অবস্থান। আর এই দুই ক্লাবের পর জি.ডি এস্তোরিল প্রাইয়া হতে যাচ্ছে প্রতিভাবান ফুটবলার গড়ার পরবর্তী কারখানা।

২০২২ লিগা পর্তুগাল-২ এ শিরোপা জিতে এস্তোরিল। বেশ কিছু প্রতিভাবান ফুটবলার গড়েন ক্লাবটি। ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এস্তোরিল। ফ্রান্স ও স্পেনে যথাক্রমে নানতেস ও সেভিলার হয়ে সফল হবার পর এস্তোরিলে যোগ দেন ২২ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান রক্ষণভাগের ফুটবলার ডিয়েগো কার্লোস। সেখান থেকে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর এখন অবস্থান করছেন ইংলিশ ক্লাব এস্টন ভিলায়।

গেল জানুয়ারিতে পর্তুগালের অনূর্ধ্ব-২১ দলের উইঙ্গার চিকুইনহো সরাসরি উলভসে চলে যান; উঠে এসেছিলেন এস্তোরিল থেকেই। চিকুইনহো এবং কার্লোসকে আগামী আসরের প্রিমিয়ার লিগে দেখা যাবে মাঠ মাতাতে। হয়তো এস্তোরিলের আরও কিছু তরুণ প্রতিভাবানও এর মধ্যে উঠে আসবে প্রিমিয়ার লিগে।

এই দুই তারকা সম্পর্কে এস্তোরিলের ক্লাব পরিচালক পেদ্রো আলভেস বলেছেন, ‘তারা দু’জনই ভিন্ন প্রকৃতির খেলোয়াড়। তবে, অসাধারণ পেশাদারিত্ব দু’জনের মাঝে। কার্লোস অসাধারণ একজন রক্ষণভাগের খেলোয়াড়। ১৭ বছর বয়সে যদি তাঁকে দেখে থাকেন, তাহলে কল্পনাও করতে পারবেন না সে এখন কোথায় আছে।’

‘সে খুব শক্তিশালী, দ্রুত দৌড়াতে পারে কিন্তু বল ধরে রাখতে তাঁর সমস্যা হতো। প্রায় এক বছর কাজ করার পর সে দারুণ একটা মৌসুম পার করেছে। সে নান্তেসের সাথেও সফল ছিল, সেভিলার সাথেও দুর্দান্ত খেলেছে এবং অ্যাস্টন ভিলার সাথেও ভাল করবে আশা করি।’ যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘চিকুইনহো একজন উইঙ্গার হিসেবে এস্তোরিলে এসেছিলো। কিন্তু সে দেখতে আমার ছোট আঙুলের আকারের মত ছিলো। তাঁর ওজন ছিলো মাত্র সাত কিলো। এক বছর কাজ করার পর তাঁর শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ উন্নতি হয়েছে। সে এখন ইংল্যান্ডে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। পরের মৌসুমে প্রথম একাদশেই সে থাকবে।’

এছাড়া ম্যাথু নুনেসও প্রতিভাবান তারকাদের একজন। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ তারকা ২০১৯ সালে এস্তোরিল থেকে প্রায় ১ মিলিয়ন ডলারে স্পোর্টিংয়ে যোগ দেন। ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গার্দিওয়ালা নুনেসকে প্রতিভাবান এক তারকা হিসেবে আখ্যা দেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই এস্তোরিলে খেলার সুযোগ পান এই তরুণ তারকা।

এস্তোরিলের জেনারেল ম্যানেজার গুইলহার্ম মুলার নুনাস সম্পর্কে বলেন, ‘সে এখনও বেশ তরুণ। একটা ম্যাচের আগে সে ইনজুরিতে পড়ে ৪৮ ঘন্টা মেডিকেল রুমে ছিল, যাতে সে প্রস্তুতি নিতে পারে। তাঁর পা ব্যান্ডেজ করা ছিল, অনেকগুলো পেইনকিলার নিয়েছিল যাতে সে খেলতে পারে। ওই ম্যাচে শুধু সে খেলেই নি, সে এতটাই দুর্দান্ত ছিল যে পরের সপ্তাহে তাঁকে স্পোর্টিংয়ের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাঁর প্রতিভা আছে, আসলে অনেক প্রতিভাবান আছে, কিন্তু তাঁর মধ্যে ভিন্ন কিছু আছে; যার কারণে সে অসাধারণ একজন খেলোয়াড়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বেশ ভাল অ্যাকাডেমি আছে। আমরা লিসবন থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে আছি। আমরা জানি বাচ্চাদের প্রথম পছন্দ হবে বেনফিকা ও স্পোর্টিং। কিন্তু তাদের আসলে এত রুম নেই। তাই আমরা প্রতিভাবানদের খুঁজে এনে সুযোগ করে দেই। তারা আসলে ২০০ খেলোয়াড়ের মাঝে ২০ বা ৩০ জনকে সুযোগ দেয়। আমরা বাকি ১৭০ জনের দিকে তাকাই এবং তাদেরকে সুযোগ দেই। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি, এস্তোরিল আন্দ্রে ফ্রাঙ্কোকে স্পোর্টিং থেকে নিলো, যখন তাঁর বয়স ছিল ১৯। আক্রমণাত্মক এই মিডফিল্ডার এখন স্পেনে স্যুইচ করবে। চেলতা ভিগো ও এলচি দু’দলই তাঁকে চাচ্ছে।’

চলতি মাসে এস্তোরিল দ্রিবল্যাবের সাথে একটা চুক্তি সম্পাদন করতে যাচ্ছে। দ্রিবল্যাব মূলত ফুটবল পরামর্শক কমিটি হিসেবে কাজ করে। যারা বিশ্বব্যাপি প্রায় ২ লাখ ফুটবলারের তথ্য সংগ্রহ করেছে। বেনফিকা, স্পোর্টিং ও এস্তোরিল ইতিমধ্যেই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়া থেকে বেশ কিছু খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়েছে।

মুলার বলেন, ‘দক্ষিণ আমেরিকাতে অনেক প্রতিভাবান আছে। কিন্তু ২০ বছর বয়সেই তাদেরকে দলে নিতে হবে। যদি আপনি ২৫ অবধি অপেক্ষা করেন, ততদিনে অনেক দেরী হয়ে যাবে। খেলোয়াড়দের রিদমে রাখতে হবে এবং দ্রুতগতিতে খেলার অনুশীলন করাতে হবে। ব্রাজিলে আপনি ছোট ছোট পাসে খেলবেন, ড্রিবল করবেন। কিন্তু ইউরোপে দ্রুতগতির ফুটবল খেলতে হবে।’

এস্তোরিলের মত ক্লাবের পক্ষে তরুণদের উপর নির্ভর করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটা বেশ কঠিন। এর মধ্যে তরুণ তারকাদের উপর অন্য দল বিড করলে ক্লাবের ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদেরকেও বিক্রি করতে হয়। প্রায় দুই বছর ধরে দল গঠনের পর প্রিমিয়ার লিগের সর্বশেষ মৌসুমে নয় নম্বরে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করে এস্তোরিল। নিজেদের কৌশল আর ব্যবসায়িক মডেল ঠিক রেখেই অবশ্য এগোচ্ছে পরে পর্তুগালের এই ক্লাব।

এস্তোরিলের এই ম্যানেজার বলেন, ‘সবাই শিরোপা জিততে চায়। ৩৫ বছর বয়সী অভিজ্ঞ তারকাকে (পেদ্রো) সাথে নিয়ে এই ব্যাপারটা অবশ্য অনেকটা সহজ। আমাদের দারুণ একটা দল আছে। তবে ব্যবসায়িক স্বার্থে আমরা খেলোয়াড় বিক্রি না করেও থাকতে পারছিনা। তবে পেদ্রোর মত অভিজ্ঞ আর অসাধারণ একজনকে ছাড়ছিনা। সবকিছুর মূলে আসরে তিন, চার, পাঁচ, ছয়জন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়কে খুঁজে বের করা; যাদের মাঝে সম্ভাবনা আছে, নিজেদের উন্নতি করতে পারবে।’

লিসবনকে প্রতিভাবানদের আতুরঘড় হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অনেকেই। গেল মৌসুমেও এই ক্লাবের প্রতি সবার প্রত্যাশার পারদ ছিল বেশ উপরে। তাই পরের বার অনেকে আবার এখানে আসলে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। শুধু যে সুন্দর সমুদ্র সৈকত আছে পর্তুগাল জুড়ে এমন নয়, এই জনপ্রিয় ক্লাবগুলোতে আছে অসংখ্য প্রতিভাবান। যেখান থেকেই হয়তো উঠে আসবে পর্তুগালের পরবর্তী ফুটবল তারকা ফুটবলাররা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link