লুকাস ভাস্কুয়েজ, শুভ্রতার প্রতীক

২০১৬ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে, ১২০ মিনিটের ক্লান্তিকর ফুটবল শেষে রিয়াল মাদ্রিদ আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ উভয় দলের খেলোয়াড়রাই ছিলেন ক্লান্ত। এর পাশাপাশি ছিল শিরোপা-নির্ধারণী টাইব্রেকারের মানসিক চাপ। দলের সেরা তারকা রোনালদো, রামোসদের মুখেও তখন ফুটে উঠেছিল সেই চাপের প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে টাইব্রেকারে প্রথম শট নিতে আসা ২৪ বছরের এক তরুণ ছিলেন একেবারে নির্বিকার। নিশ্চিন্ত মনে হাতের মধ্যে বলকে ঘোরাতে ঘোরাতে এসেছিলেন, যেন পার্কে খেলতে যাচ্ছেন। এরপর আলতো শটে জালে জড়িয়ে দিলেন বলটা। এখন পর্যন্ত এটাই তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হাইলাইটস হয়ে আছে।

এতটুকু পড়তেই সুদর্শন এক স্প্যানিশ তরুনের চেহারা ভেসে উঠেছে নিশ্চয়ই। তার নামটা – লুকাস ভাস্কুয়েজ ইগলেসিয়াস, যিনি মাদ্রিদের সফেদ জার্সির সম্মান রক্ষার্থে সবকিছু করতেই রাজি।

১৯৯২ সালের জুলাইয়ের প্রথম দিনে স্পেনের কার্টিসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন লুকাস ভাস্কুয়েজ। রিয়াল মাদ্রিদের সাথে তার পথচলা শুরু হয় ১৬ বছর বয়সে। স্থানীয় দুই একাডেমিতে পাঠ নেয়া শেষে তিনি এসেছিলেন লা ফ্যাব্রিকাতে। ভাস্কুয়েজ আর সফেদ জার্সির প্রেমের গল্পের সেখানেই শুরু। এরপর রিয়াল মাদ্রিদ বি এবং রিয়াল মাদ্রিদ সি দলের হয়ে খেলেছিলেন বেশ কয়েক বছর।

২০১৪ সালে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য লা লিগার আরেক ক্লাব এস্প্যানিওলে তাকে ধারে পাঠানো হয়। সেখানে থেকে যাওয়ার জন্য পাঁচ বছরের চুক্তিও করেছিলেন লুকাস। কিন্তু রিয়ালের তৎকালীন কোচের বড্ড মনে ধরেছিল তরুণ ভাসকেজকে। তাই পরের বছরই বাই-ব্যাক অপশন কাজে লাগিয়ে পুরোনো ঠিকানায় নিয়ে আসা তাকে।

এরপর থেকে প্রায় সাত বছর এখানেই আছেন লুকাস ভাস্কুয়েজ। কখনো রাইট উইঙ্গার, কখনো মিডফিল্ডার আবার কখনো নিয়মিত ডিফেন্ডারদের অনুপস্থিতিতে দলের রক্ষন সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন ভাস্কুয়েজ। সবমিলিয়ে অল হোয়াইটদের হয়ে এখন পর্যন্ত ২৮১ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। বর্তমান দলের অন্যতম অভিজ্ঞ সদস্যও বটে।

মূলত ২০২০/২১ মৌসুমে জিনেদিন জিদানের অধীনে লুকাস ভাস্কুয়েজের ‘ভার্সেটাইল গুণ’ প্রথম চোখে পড়ে। বিশেষ করে সার্জিও রামোস, রাফায়েল ভারানে আর দানি কারভাহালদের ইনজুরির কারনে বাধ্য হয়েই তাকে রক্ষনভাগে খেলাতে হয়েছিল কোচকে। সেই থেকে নিজের পুরোনো উইঙ্গার পরিচয় ছেড়ে দ্বিতীয় পছন্দের রাইটব্যাক হিসেবেই দলের সাথে আছেন এই স্প্যানিশ। এমন আত্মত্যাগের কারন একটিই, হৃদয়ে থাকা বিশুদ্ধ মাদ্রিদিজম।

প্রত্যেক দলেই ‘স্কোয়াড প্লেয়ার’ থাকাটা আবশ্যক। তাদের কাজই একাদশের ঘাটতি পূরন করা। তারা বিভিন্ন পজিশনে খেলতে পারেন, তারা প্লেয়িং টাইম নিয়েও মাথা ঘামান না বরং যতটুকু সুযোগ পাওয়া যায় তাতেই দলের জন্য সর্বোচ্চ করতে চান। ফুটবল সম্পর্কে কিছুটা খোঁজখবর রাখলে তর্কবিতর্ক ছাড়াই বলা যাবে, রিয়াল মাদ্রিদে বর্তমান বিশ্বের সেরা ‘স্কোয়াড প্লেয়ার’দের একজন আছেন। তিনি যে লুকাস ভাস্কুয়েজ সেটি বলে দেয়া লাগে না।

লুকাস ভাস্কুয়েজ তার পরিশ্রম করার সক্ষমতার জন্য বেশ পরিচিত। পুরো নব্বই কিংবা একশ বিশ মিনিট একদমে মাঠের সর্বত্রই দৌড়ে বেড়াতে পারেন তিনি। না, তিনি তো ডিফেন্সের তালিম নেননি ক্যারিয়ারের শুরুতে তবু সময়ের প্রয়োজনে এখন তিনি যথেষ্ট সলিড হয়ে উঠেছেন। প্রেসিংয়ে আক্রমণাত্বক, ট্যাকলে পারদর্শী এই খেলোয়াড়ের উপর তাই ভরসা করতেই পারেন যেকোনো কোচ।

নিজের মাদ্রিদ অধ্যায়ে কখনো বেতন নিয়ে কথা বলেননি লুকাস ভাসকেজ, কখনো প্রশ্ন তুলেননি প্লেয়িং টাইম নিয়ে। এমনকি ক্লাব ছাড়তে চেয়ে জল ঘোলাও করা হয়নি তার। এককথায়, কোন অভিযোগই নেই তার কন্ঠে। শুধু খেলোয়াড়ই নয়, সম্ভবত রিয়াল মাদ্রিদের সবচেয়ে একনিষ্ঠ ভক্তদের মধ্যে অন্যতম লুকাস। এতকিছুর পরেও সবচেয়ে কম প্রশংসা পাওয়া সদস্যের মাঝে একজন লুকাস ভাসকেজ।

২০১৫ সালে তাকে স্কোয়াডে ফিরিয়ে আনার পর থেকে, লস ব্ল্যাঙ্কোসদের জন্য নিঃস্বার্থ ভূমিকা পালন করছেন ভাস্কুয়েজ। যখন যেভাবে ডাকা হয়েছে, তখন নিজের দক্ষতার বাইরে গিয়ে হলেও সেটা করেছেন। কতটুকু করতে পেরেছেন সেটা তো মাঠে দেখাই গিয়েছে, তবে যেটা আড়ালে ছিল সেটা তার ডেডিকেশন।

লা লিগার সেরা তিন চারটি ক্লাব বাদে আর যেকোনো ক্লাবের প্রথম একাদশে নি:সন্দেহে জায়গা পেতে পারতেন ভাস্কুয়েজ। কিন্তু রিয়ালের হয়ে অন্তত কিছু সময় হলেও খেলার জন্য নিজেকে বারবার ভেঙ্গে গড়েছেন তিনি। রয়্যাল ক্রেস্টের জন্য নিজের শতভাগ বা তারও বেশি দিয়েছেন কিংবা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।

খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ কিংবা দ্রুতগতির নাও হতে পারেন, তবু লুকাস ভাস্কুয়েজ বিশেষ। ক্লাবের জন্য অনুগত সেবক তিনি, তিনি কোচের কাছে ভরসাযোগ্য একজন আর সমর্থকদের কাছে মাদ্রিদিজমো-এর আদর্শ ।

বীরদের জন্ম ঢাক-ঢোল পিটিয়ে হয় না, তারা তৈরি হয় অন্ধকারে, নীরবে। তারা বেড়ে উঠে যুদ্ধের জন্য। নি:স্বার্থ আত্মত্যাগে নিজেদের সংজ্ঞায়িত করে তারা। ঠিক এমনই একজন লুকাস ভাসকেজ। নীরবে নিভৃতে নিজের দায়িত্ব পালন করে যান তিনি।

হয়তো রিয়াল মাদ্রিদের সেরা খেলোয়াড়দের একজন নন, তবে শান্ত আর প্রত্যয়ী লুকাস ভাসকেজ জানেন তিনি কি করতে পারেন, তিনি কি করবেন। লা ফ্যাব্রিকা’র সেই ছেলেটা বড় হয়েছে, ত্রিশের কোটায় পা রেখেছে। তবে এত সময় পরেও বদলায়নি তার প্রেম।

পরিসংখ্যানের হিসেবে নিতান্তই সাদামাটা একজন লুকাস ভাসকেজ। তবে সাদা শার্টের প্রতি তার নিঁখাদ ভালোবাসা হয়তো তাকে কিংবদন্তির মর্যাদা এনে দিবে, হয়তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাদ্রিদিজমো-র উদাহরণ দিতে তার নামটাই উচ্চারিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link