উইনস্টন গ্রুমের উপন্যাস ‘ফরেস্ট গাম্প’ অনেকেই হয়ত পড়েননি। তবে ১৯৯৪ সালে হলিউডে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটা দেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যার প্রধান চরিত্রের দুই পা জুড়ে ছিল লোহার পাত। জেনির ‘রান ফরেস্ট রান!’ আর ফরেস্টের আপ্রাণ দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টার দৃশ্যটা নিশ্চয়ই চোখে লেগে আছে।
লোহার পাত ভেঙে ফরেস্ট সেদিন দৌড়েছিল প্রথমবার। কী ভূবনমোহিনী এক দৃশ্য!
এমন এক গল্প আমাদের ক্রিকেট পাড়া বহন করছে সে খবর কি রাখেন? খানিক ভিন্ন গল্প। তবুও লোহার সকল শিকল ভাঙ্গার গল্পটা এক। লোহার ভার পিছুটানে, তবে স্বপ্নের পানে ছুটে যাওয়া কি আর আটকানো যায়? স্বপ্ন তো সকল প্রতিবন্ধকতার উর্ধ্বে। মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ সে স্বপ্নই যেন একটু একটু করে ছুঁয়ে দেখছেন।
মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ, খুব একটা পরিচিত নাম নয় নিশ্চয়ই। তবে ক্রিকেট মাঠে যাদের নিয়মিত যাতায়াত তাঁরা হয়ত চিনবেন। স্টাইলিশ খেলোয়াড় হিসেবেই তিনি বেশ নজর কেড়েছেন। তবে তিনি মূলত আলোচনায় রয়েছেন নিজের বোলিং প্রতিভার জন্যে। জীবনের শুরুতেই যাকে দিতে হয়েছে কৃত্রিম শ্বাস তিনিই এখন দেশের ব্যাটারদের নাভিশ্বাসের কারণ।
তিন বছর বয়সে মুগ্ধর পা নাকি যাচ্ছিলো বেকে। অগ্যতা ডাক্তার পরামর্শ দেন, তাঁকে পড়তে হবে লোহার জুতো। ঠিক ফরেস্ট গাম্পের প্রধান চরিত্রের মত। তবে সে দিন হয়েছে গত। মুগ্ধ এখন আপন গতিতে ছুটে বেড়ান ক্রিকেট মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। তবে ডাক্তারের নাকি ছিল কড়া নির্দেশ, দৌড়ানো যাবে না মোটেও। সে পরিস্থিতি পেরিয়ে অদম্য মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছেন।
যোদ্ধা শব্দটা বোধহয় তাঁর সাথেই যায়। ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছেন। এরপর তো পায়ের শিকল। তবে তিনি দমে যাননি। ক্রিকেট নেশায় হয়েছেন মত্ত। জাতীয় দলের হয়ে ক্রিকেট খেলার স্বপ্নে বিভোর তিনি ভর্তি হয়ে যান বাংলাদেশ ক্রিড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেখানেই পড়াশুনার পাশাপাশি চলে তাঁর ক্রিকেট দীক্ষা। ধাপে ধাপে তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন।
তিনি বোলিংটাকে আরও বেশি করেছেন শাণিত। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে সুইং। তিনি বাইশ গজের শক্ত মাটিতে বলের গতিপথ নির্ধারণ করে দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন। একজন পেস বোলারের প্রধান অস্ত্রই তো সুইং। তিনি বাতাসের সাথে মিলিয়ে নিজের দক্ষতার প্রমাণ রাখবেন। পিচ থেকে সাহায্য না পেলেও বলের পূর্ণ ব্যবহার তিনি করবেন। মুগ্ধ সেটাই করার চেষ্টা করেন।
সফলতাও এসে ধরা দেয় তাঁর কাছে। তিনি তো বর্তমানে রয়েছেন জাতীয় দলের সন্নিকটে। বাংলাদেশ হাই পারফরমেন্স ইউনিটের হয়ে রাজশাহীতে চারদিনের ম্যাচও খেলেছেন তিনি। বল হাতে সেখানেও মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন মুকিদুল মুগ্ধ। বয়সভিত্তিক পর্যায়ের প্রতিটা স্তরেই তাঁর বোলিং বিশেষ নজরে ছিল বাংলাদেশের কর্তাদের। তাঁরই ধারাবাহিকতায় তিনি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষের প্রাথমিক দলেও ছিলেন।
তবে সে জায়গটা তিনি বরং অর্জন করেই নিয়েছিলেন। তবে তিনি যে যোদ্ধা তাঁর প্রমাণই যেন আবার রেখেছিলেন কিছুদিন আগে শেষ হওয়া ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে। পেস বোলারদের সবচেয়ে বড় শত্রু ইনজুরি। সে ইনজুরি এসে ভর করেছিল মুকিদুলের। তবে ইনজুরি কাটিয়ে নিজের ছন্দে ফিরতে সময় নেননি মুগ্ধ।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে নিয়েছিলেন ১৯ খানা উইকেট। সেটা তো তাঁর সামর্থ্যের প্রমাণই করে। বাংলাদেশের পেস বোলারদের একটা বিবর্তন হচ্ছে। জাতীয় দলে পেসাররা ভাল করতে শুরু করেছেন। অপরদিকে পাইপলাইনটা মজবুত করছেন মুগ্ধরা। মুগ্ধ ছাড়াও হাই পারফরমেন্স ইউনিটে থাকা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরি, রিপন মণ্ডল, মুশফিক হাসানরা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের আগামী দিনের পেস আক্রমণের সামলানোর।
মুগ্ধ অন্তত হারিয়ে যাওয়ার জন্যে আসেননি। তিনি লড়াই করেছেন মৃত্যুর সাথে। তিনি তো লড়াকু সৈনিক। হাজারটা বাঁধা তিনি নিশ্চয়ই উৎরে যাবেন। একদিন লাল-সবুজ জার্সি গায়ে এক স্টেডিয়াম মানুষের সামনে গেয়ে উঠবেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’