২০২১ সালের জুন, ফুটবল বিশ্ব তখন মগ্ন হয়ে আছে ইউরো টূর্নামেন্টের জাদুতে। সেই টুর্নামেন্টে ডেনমার্ক তাদের উদ্বোধনী ম্যাচে মাঠে নেমেছিল ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে। ম্যাচের তখন ৪২ মিনিট, থ্রো-ইন নিতে গিয়েছিলেন ডেনমার্কের এক মিডফিল্ডার।
কিন্তু, হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। দ্রুত স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়ার পর নিতে হয় হাসপাতালে। পরে জানা যায় হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তাঁর। গত বছরের ইউরোর আসর অনুসরণ করলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভেসে উঠেছে ক্রিশ্চিয়ান এরিকসনের মুখচ্ছবি।
ফুটবলের জন্য সেটি ছিল বিভীষিকাময় স্মৃতি; সতীর্থ থেকে শুরু করে ভক্ত-সমর্থকদের প্রার্থনায় ছিলেন এরিকসেন। সেই প্রার্থনার শক্তিতেই হয়তো দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠেন তিনি। অনেক ধরে নিয়েছিল এমন অসুস্থতার পর হয়তো আর মাঠে দেখা যাবে এই মিডফিল্ডারকে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে কয়েক মাসের মধ্যে হাসিখুশি এরিকসনকে দেখা যায় সবুজ মাঠে। অদম্য মানসিকতার জোরে তিনি ফিরে এসেছিলেন ট্রেনিংয়ে।
কিন্তু বিধিবাম, হার্ট অ্যাটাকের আগে ক্রিস্টিয়ান এরিকসন খেলতেন ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানে। কিন্তু ইতালিয়ান লিগের নিয়মানুযায়ী কোন হার্ট সমস্যাযুক্ত কোন খেলোয়াড়কে স্কোয়াডে রাখা যায় না। তাই বাধ্য হয়েই পুরোনো ক্লাব ইন্টার মিলানকে বিদায় বলতে হয়। অবশ্য ফ্রি এজেন্ট হয়ে বসে থাকেননি তিনি, এর কয়েকদিন পরেই শীতকালীন দলবদলে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ব্রেন্টফোর্ড ভরসা রাখে তাঁর উপর, দলটির সাথে ছয় মাসের চুক্তি স্বাক্ষর করেন এরিকসেন।
দিব্যি আট-দশজন স্বাভাবিক ফুটবলারের মতই এরপরের সময়টা খেলে গিয়েছিলেন এই মিডফিল্ডার। নতুন দলের হয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি নিউক্যাসেলের বিপক্ষে অভিষেক হয় তার, মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফেরার পর প্রায় আট মাসের বিরতি কাটিয়ে সেদিন প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে ফিরেছিলেন এরিকসেন।
দর্শকরাও দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাতে ভুলে করেনি এই যোদ্ধাকে। সবমিলিয়ে জানুয়ারির পর থেকে মৌসুমের শেষপর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবটির হয়ে ১১ ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন এরিকসেন, একটি গোলের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করেছিলেন চারটি।
অন্যদিকে ডেনমার্কের জার্সিতেও ফিরেছিলেন মার্চেই। ফেরার ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে গোলও পেয়েছিলেন এই ড্যানিশ তারকা। এরপরের ম্যাচেও সার্বিয়ার বিপক্ষে জালের দেখা পান তিনি। সবমিলিয়ে এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও নিজেকে প্রমান করেছেন ক্রিস্টিয়ান এরিকসন। ধরে রেখেছেন নিজের স্বাভাবিক পারফরম্যান্স।
আর তাই ভঙ্গুর অবস্থায় থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মিডফিল্ডে শক্তি বাড়াতে নিজেদের দলে টেনে নিয়েছে তাকে। ব্রেন্টফোর্ডের সাথে তার চুক্তি জুন মাসে শেষ হওয়ার পরেই ফ্রি এজেন্ট হিসেবে রেড ডেভিলদের সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি করেন এরিকসন। খুব শীঘ্রই মেডিক্যাল টেস্ট করার পরে আনুষ্ঠানিকভাবে তার চুক্তির কথা ঘোষনা করা হবে।
ক্রিস্টিয়ান এরিকসনের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে আগমনের পিছনে সবচেয়ে বড় ভুমিকা রেখেছেন ইউনাইটেডের নতুন কোচ এরিক টেন হ্যাগ। নিজের স্পোর্টিং প্রজেক্টের ব্যাপারে এরিকসনের সঙ্গে তার দুইবার মিটিং হয়েছে বলেও জানা গিয়েছে৷ এছাড়া এই দুইজনেরই অতীতে একটা মিল রয়েছে৷ টেন হ্যাগ এবং এরিকসন উভয়ই একটাসময় পর্যন্ত আয়াক্স শিবিরে ছিলেন – ২০১৩ পর্যন্ত এরিকসন ছিলেন ডাচ ক্লাবটির খেলোয়াড় অন্যদিকে টেন হ্যাগ ২০১৭ সালের পর থেকে আয়াক্সের কোচ ছিলেন।
অবশ্য সাবেক ক্লাব ব্রেন্টফোর্ড এই ৩০ বছর বয়সী ফুটবলারকে নিজেদের শিবিরে রাখতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু এরিকসন নিজেই বেছে নিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে। এরিকসেনকে দলে ভেড়ানোর কাজ প্রায় শেষ; এরিক টেন হ্যাগের এবার পরবর্তী লক্ষ্য বার্সেলোনার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, আয়াক্সের লিসান্দ্রো মার্টিনেজ এবং অ্যান্টনি।
নিজের প্রথম ট্রান্সফার উইন্ডো কাজে লাগাতে বেশ উন্মুখ হয়ে আছেন ডাচ ট্যাকটিশিয়ান।
ক্রিস্টিয়ান এরিকসন এবারের মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দ্বিতীয় সাইনিং। এর আগে ডাচ লেফটব্যাক তাইরেল ম্যালাসিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছিল দলটি। আগামী কয়েকদিনে আরো কিছু খেলোয়াড়কে নিজেদের করে নিতে চাইবে ক্লাব ম্যানেজম্যান্ট। তাছাড়া দলকে গুছিয়ে আরো শক্তিশালী করতে পারলে মূল তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকেও হয়তো ধরে রাখতে সক্ষম হবে ইউনাইটেড।
আপাতত, ইউনাইটেড ভক্তদের চোখ ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের উপরেই। যমদূতের সাথে লড়াই করে জয়ী হয়ে ফেরা এই মিডফিল্ডার এবার তাদের হয়ে লড়বেন – প্রত্যাশার পারদ তাই একটু উপরেই। এরিকসেনের নিজেরও হয়তো লক্ষ্য থাকবে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের মাঝমাঠে ভরসাযোগ্য একজন হয়ে ওঠা। নতুন পরিবেশ আর নতুন কোচের অধীনে সমর্থকদের প্রত্যাশা আর নিজের লক্ষ্য কতটা পূরণ করতে পারেন তিনি, সেটিই এখন দেখার বিষয়।