তাঁকে বলা হয়ে থাকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বরপুত্র। নামের পাশে তিন অংকের স্ট্রাইকরেট যেন বিধাতার দেয়া কোনো পাকাপোক্ত অধিকার। ক্রিকেট মাঠের নির্ধারিত বাউন্ডারী নয় বরং গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড অথবা স্টেডিয়াম-রুফটপকেই যিনি নিজের সীমানা মনে করেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি লাল বলের ক্রিকেটেও যে নিজের ক্ষমতাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে বহুদূর তার সাক্ষী শ্রীলঙ্কার গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম।
ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে যার শুরুটা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০০ সালে। ক্যারিয়ার বিল্ডিং কিছুটা মন্থর হলেও নিজেকে মেলে ধরতে সময় নেননি ‘ইউনিভার্সাল বস’ হিসেবে খ্যাত এই ওপেনার ব্যাটসম্যান। ২০০১ এ নিজের প্রথম সেঞ্চুরি আর তার পরের বছর অভিষেক ডাবল সেঞ্চুরির মাধ্যমে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন নতুন কোনো সম্ভাবনার।
২০০৫ সালে শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলেন ব্রায়ান লারারই উত্তরসূরি হিসেবে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ক্যারিয়ার সেরা ট্রিপল থ্রি-এর ট্রিপল সেঞ্চুরি ফিগার যেন একটু বেশিই স্পেশাল এই ক্যারিবীয় তারকার কাছে। নিজের জার্সি নাম্বার ৩৩৩ কিন্তু এর স্বপক্ষেই সাক্ষ্য দেয়!
সাদা জার্সির ক্রিকেটে ২০১০ বছরটা ঠিক সুবিধের যাচ্ছিল না গেইলের। ২০০৯ এ পরাশক্তি ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চার-চারটা সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর একটু যেন ফিঁকে হয়ে যাচ্ছিল সে সময়টা। তৎকালীন আইপিএল মাতিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনার ভিড়ে। শ্রীলঙ্কা সফরের টেস্ট ম্যাচটা ছিল জাতীয় দলের প্রতি তাঁর ডেডিকেশনের স্বরূপ উপস্থিতির।
নভেম্বরে মাঝামাঝি শুরু হওয়া প্রথম টেস্টে টসে জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ কাপ্তান ড্যারেন স্যামি। সদ্য ক্যাপ্টেন্সি হারানো ক্রিস গেইল নামেন ওপেনিং এ। শুরুতে ধামিকা প্রসাদের বলে ব্যাটিং প্লেসমেন্টে ঝামেলা পোহাতে হলেও থুসারার বলে বেশ তাড়াতাড়িই নিজের ছন্দে ফিরতে দেখা যায় গেইলকে।
ওয়ানডে স্ট্যান্ডার্ডের রানরেট আর স্ট্রাইকরেট ধরে রেখে স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিকেট উপহার দিতে থাকেন গেইল-ব্যারেথ জুটি। পরবর্তীতে দলীয় ৩৯তম ওভারে নার্ভাস নাইনটির গেইলের ডাউন দ্যা উইকেটে এসে টানা এক চার দুই ছয়ে সেঞ্চুরি তুলে নেয়াটা প্রমাণ করে গেইল কতখানি গেইল। শ্রীলংকার মাটিতে প্রথম সেঞ্চুরির উদযাপনটা ছিল স্পেশাল। দুহাত উপরে তুলে মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে যেন চাপা দিলেন সমালোচনার পাহাড়কেই।
তবে ইনিংসের পরিধি জানলে হয়তো কিছুটা উচ্ছ্বাস জমিয়ে রাখতেন গেইল।সেঞ্চুরির পর পুরনো আত্মবিশ্বাসে ভর করে ব্রাভোর সাথে গেইল গড়ে তোলেন লম্বা ইনিংস। দিনের শেষভাগে এসে ব্যাক্তিগত ১৮৫ রানে ব্রাভো প্যাভিলিয়নে ফিরলেও তেমন ভাবান্তর দেখা যায়নি গেইলের ব্যাটে। ৮১তম ওভারে মাত্র ২২১ বলে তুলে নেন নিজের তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি। ২১৯ রানে অপরাজিত থেকে ফুরফুরে আমেজে প্রথম দিনের খেলা শেষ করেন ক্রিস গেইল। স্কোরবোর্ডে তখন ক্যারিবিয়ানদের পক্ষে ৩৬২/২ এর রাজকীয় স্কোরলাইন।
স্বাভাবিক ভাবেই লংকান বাহিনী দ্বিতীয় দিনের শুরুটা সহজ করে তোলেনি গেইলদের জন্য। প্রসাদ-মেন্ডিস স্পেলে প্রথম ১৫ ওভারে গোটা কয়েক রান ওঠে স্কোরকার্ডে। দলীয় ১১০তম ওভারে ২৫০ রানের মাইলফলক স্পর্শের কিছুক্ষণ আগে ভেঙে যায় চন্দরপালের সঙ্গে গড়া জুটি।
এরপর থেকেই যেন শুরু হয় রেকর্ডের হিসাব-নিকাশ। ২৫৬ রান পেরোনোর সাথে সাথে গেইল বনে যান এই উপমহাদেশে কোনো ক্যারিবিয় ব্যাটসম্যানের পক্ষে সর্বোচ্চ স্কোরার। ব্র্যান্ডন ন্যাশকে নিয়ে ধীরে ধীরে আগাতে থাকেন ত্রি-শতকের লক্ষ্যে। লাঞ্চ ব্রেকের পরই দলীয় ৫০০ রানের কোটা পার হবার পর লংকান বোলারদের কেবল অসহায়ই ঠেকছিল এই সেট জুটির সামনে।
চা বিরতির আগেই অপেক্ষার পালা শেষ করেন ক্রিস গেইল। মেন্ডিসের বলে কভার ড্রাইভে বাউন্ডারির মাধ্যমে ইতিহাসের চতুর্থ আর ব্রায়ান লারার পর দ্বিতীয় উইন্ডিজ ব্যাটসম্যান হিসেবে অর্জন করেন দ্বিতীয় ত্রিশতক স্পর্শের রূপকথা। তৃপ্তির হাসি নিয়ে হাঁটুগেড়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বিধাতার প্রতি। ঐতিহাসিক এই ইনিংস শেষ অবশ্য তখনো দেখেনি বিশ্ব।
মেন্ডিসের বলে ক্লিন বোল্ড হওয়ার আগে ৩৪ টি চার আর নয় ছয়ে সাজানো ইনিংসে ৪৩৭ বলে গেইল যোগ করেন ৩৩৩টি রান। মাত্র এক রানের জন্য স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪ ছুঁতে না পারার আক্ষেপ থাকলেও স্বস্তি হিসেবে ছিল নিজের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভাঙার কীর্তি। এছাড়াও ইউনুস খানের ৩১৩ রানের রেকর্ড ভেঙ্গে শ্রীলংকার বিপক্ষে যে কোনো দলের কোনো একক সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডও এখন গেইলের দখলে।
পরিশেষে ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি লিগ বলুন, অথবা ধৈর্য পরীক্ষার টেস্ট ক্রিকেট; গেইল-ঝড়ের জাদুকরী তাণ্ডবের সাক্ষী রয়েছে পুরো ক্রিকেট বিশ্বই। আর যত দিন এগোচ্ছে – ততই যেন পরিণত হচ্ছে এই ঝড়!