একটি খেলা, একটি গোল এবং একটি ট্রফি। ডারউইন নুনেজের এর চেয়ে ভাল অভিষেক আর হতে পারতো না। কেউ যখন একটি নতুন লিগে একটি নতুন ক্লাবে পৌছান, আর তা যদি হয় একটা বড় ট্রান্সফার ফির বদৌলতে তখন সেই খেলোয়াড় প্রথম যে জিনিসটা খুব করে চান তা হল তার শুরুটা যেন ভাল হয়৷ এই উরুগুইয়ান অবশ্যই তা করেছেন।
শনিবার কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামে এফএ কমিউনিটি শিল্ডে ম্যানচেস্টার সিটিকে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য বেঞ্চ থেকে নুনেজ মাঠে নামার পর তাকে নিয়ে ‘তার এবং আমাদের উভয়ের জন্যই বড় ব্যাপার’ – এটাই ছিল ভার্জিল ভ্যান ডাইকের বক্তব্য।
৬৪ মিলিয়ন পাউন্ড দামের আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় লিস্টারে মাত্র আধ ঘন্টার চেয়ে বেশি কিছু সময় মাঠে থেকে দেখিয়ে দিলেন কেন লিভারপুল তাকে বেনফিকা থেকে দলে ভেড়াতে এত আগ্রহী ছিল, কেন ভ্যান ডাইক তাকে নিখুঁত ‘আধুনিক কালের স্ট্রাইকার’ বলে বিশ্বাস করে, এবং কেন ইয়ুর্গেন ক্লপ নিশ্চিত যে ২৩ বছর বয়সী এই ফুটবলার তার দলকে আরও মজবুত করবে, যেই দল গত মৌসুমের শেষ পর্যন্ত চারটি শিরোপা জেতার জন্য খেলছিল।
- হাল্যান্ডকে ছাপিয়ে যাওয়া
ম্যাচের ৫৮ মিনিটে রবার্তো ফিরমিনোর বদলি হিসেবে মাঠে নামার পর থেকেই নুনেজ ম্যাচে তার প্রভাব ফেলেন। অপরদিকে সিটির নিজস্ব ‘বিগ মানি সাইনিং’ আক্রমণভাগের খেলোয়াড় আরলিং হাল্যান্ড। তিনি ম্যাচের শুরু থেকেই মাঠে ছিলেন, ম্যাচে নিজের কোন ছাপ ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্য যেকোনো খেলোয়াড়ের তুলনায় তার পায়ে বল অনেক কম এসেছে। তার পাস সম্পন্ন করার সংখ্যাটাও অনেক ছিল। লিভারপুলের নতুন নাম্বার ২৭ নুনেজ ছিলেন তার ঠিক বিপরীত ম্যাচে নিজের ছাপ ফেলতে যেন মরিয়া ছিলেন তিনি এবং তাই করেছেন।
তিনি গোল বরাবর চারটি শট নেন যা হাল্যান্ড থেকে বেশি। বড় সুযোগ তিনটি সুযোগ পেয়েছিলেন যা লিভারপুলের যে কোনও খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি। প্রতিপক্ষের ডি বক্সে বল পাচবার তাঁর পায়ের ছোয়া পেয়েছেন, ৯০ মিনিট ধরে খেলা হ্যাল্যান্ডের চেয়ে সংখ্যাটা মাত্র একটি কম।
তিনি তার দলের পক্ষের একটি পেনাল্টি জিতেছিলেন, তার হেড করা বলে রুবেন দিয়াস হাত লাগিয়েছিলেন যার ফলশ্রুতিতে পাওয়া পেনাল্টি থেকে মোহাম্মদ সালাহ গোল করেন। ম্যাচে অল রেডরা এগিয়ে যায়। এরপর ইনজুরি টাইমে অ্যান্ডি রবার্টসনের করা ক্রসে ঝুকে পড়ে মাথা লাগান নুনেজ, যা গোলরক্ষক এডারসনকে পরাস্ত করে এবং তার দলের ৩-১ ব্যবধানে জয় নিশ্চিত করে।
- নতুন সমর্থকদের সাথে মেলবন্ধন
গোলের পর তার করা উদযাপনই বলেছিল এই মুহূর্তটা তাঁর জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ । নুনেজ উন্মত্ত লিভারপুডলিয়ানদের সামনে তার জার্সি খুলে তাঁর আবেগের বহি:প্রকাশ ঘটান যা তিনি এবং সমর্থকরা উভয়ই উপভোগ করেন।
তাঁর ওপর যে সমর্থকদের নজর ছিল সে ব্যাপারে কোন প্রশ্ন নেই। প্রথমার্ধে যখন তিনি ওয়ার্মআপ করছিলেন এবং দ্বিতীয়ার্ধে যখন বদলি হিসেবে তাঁকে মাঠে নামানো হয় তখন সমর্থকরা তারা তাঁর নাম ধরে ডাকছিল, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল। তাঁর গোলের পর তো অল রেড সমর্থকরা নিজেদের স্ট্যান্ডে উরুগুয়ের পতাকাই উড়িয়ে দেন যা লুইস সুয়ারেজে যাওয়ার পর আর দেখা যায়নি।
সুয়ারেজও মার্সিসাইডে আসার পর পরই মাঠে খেলার মাধমে নিজের প্রভাব ফেলেছিলেন এবং নুনেজ যদি তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারেন, তবে নি:সন্দেহে বলা যায় লিভারপুল সমর্থকদের চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না।
তিনি সুয়ারেজের মত নিয়মিত মাঠ কাপাবেন কিনা তা আগাম বলা সম্ভম নয়। অ্যানফিল্ডে এক নতুন নায়কের আগমন ঘটেছে, আপাতত সমর্থকরা কেবল এই মুহূর্তটি উপভোগ করতে পারেন।
- গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলো!
প্রাক-মৌসুমে নুনেজের পারফরম্যান্স বেশ সমালোচনা হয়েছিল। অনেকে তো তাকে বাতিলের খাতায়ই ফেলে দেন, বলেন তিনি ফ্লপ যা শুধু তিনি নন বরং তার সতীর্থরাও শুনেছে এবং অনুভব করেছে।উদাহরণস্বরূপ, আমরা অ্যান্ডি রবার্টসনের একটি সাক্ষাত্কারের কথা বলতে পারি যেখানে তাকে আমরা – ‘সম্প্রতি তাঁর সম্পর্কে লোকে অনেক ফালতু কথা বলেছে’ উল্লেখ করতে শুনেছি, এবং ক্লপ তার ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে নতুন খেলোয়াড়ের ফর্মের ব্যাপারে কথোপকথনের সময় এই সব সমালোচনাকে রসিকতা বলে উড়িয়ে দেন।
এদিকে, ভার্জিল ভ্যান ডাইক তার নতুন সতীর্থকে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন, ‘একটি ম্যাচের পরে আপনারা তাঁর সম্পর্কে কি বলছেন তা তার না দেখলেও চলবে!’ এই ডাচ ফুটবলার সংবাদ সম্মেলনে আসা এক ঝাক সাংবাদিকদেরকে উদ্দেশ করেই কথা গুলো বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘তাকে কেবল নিজের উপর, দলের উপর ফোকাস করতে হবে, উন্নতি করতে হবে, যাতে তাড়াতাড়ি সম্ভব দলে থিতু হতে পারে।’
‘এটা করার একমাত্র উপায় হল ট্রেনিং থেকে শেখা, আপনি যে ম্যাচগুলি খেলেন তা থেকে শেখা এবং অন্যরা আপনার এবং আপনার পারফরম্যান্স সম্পর্কে কী বলছে তা না দেখা, এটাই, আমার জন্য, সাফল্যের চাবিকাঠি। অন্যান্য সমস্ত জিনিস দ্বারা আপনি শুধু বিভ্রান্ত হবেন।’ যোগ করেন তিনি।
- আধুনিক কালের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়
এটি শুধুমাত্র একটি ম্যাচ ছিল যাকে প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসেবেও তেমন ধরা হয় না। নুনেজ এবং লিভারপুলের সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে, যদিও তার আনন্দ এবং হাল্যান্ডের দুর্ভাগ্যের জন্য খুশি হয়ে অনেকেই উদযাপন করছে। এই এক ম্যাচের ফলের উপর নির্ভর করে তাদের ব্যাপারে রায় দেওয়া মূর্খের মত কাজ হবে যা নুনেজের প্রাক-মৌসুম পারফরমেন্স দেখে তাকে বাতিলের খাতায় ফেলার সমতুল্য।
ভ্যান ডাইক হাল্যান্ড এবং নুনেজ উভয়েরই মুখোমুখি হয়েছেন, এবং তাই তাদের দক্ষতা এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে কথা বলার জন্য তিনি উপযুক্ত ব্যক্তি। তার কোন সন্দেহ নেই যে নুনেজ এবং হাল্যান্ড উভয়ই প্রিমিয়ার লিগে জ্বলে উঠবেন।
নুনেজ সম্পর্কে তিনি বলেন ‘আপনি দেখেন তিনি ডাইরেক্ট, তিনি রক্ষণের পিছনে ভাল দৌড় দিতে পারেন, তিনি দ্রুত, তিনি শক্তিশালী।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, আমি মনে করি সে একজন আধুনিক স্ট্রাইকার। হাল্যান্ড একই রকমের খেলোয়াড়। তাদের একই বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে খেলা কঠিন।’
‘তার স্পষ্টতই অনেক গুণাবলী রয়েছে যা রক্ষণের খেলোয়াড়দের জীবনকে কঠিন করে তুলতে পারে। ইংল্যান্ডে রক্ষণে খেলা খেলোয়াড়দের জীবন দুর্বিষহ করে দেবেন তিনি! তিনি খুব ডাইরেক্ট। তার সবই আছে; সে বল হেড করতে পারে, সে দ্রুত।’ হাল্যান্ড সম্পর্কে ভ্যান ডাইক তার এই বক্তব্য দেন।
এছাড়াও লিভারপুলের রক্ষণভাগের এই খেলোয়াড় বলেন, ‘যে খেলোয়াড়রা বড় মূল্যের ট্যাগ নিয়ে আসছে তাদের উপর চাপ থাকবেই, কিন্তু আপনি কী করতে পারেন? আপনি পারফর্ম করতে আসছেন, এবং ক্লাব আপনার জন্য একটি ফি প্রদান করেছে। আপনাকে শুধু কাজ করতে হবে, এবং এ ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব গোল করার চেষ্টা করুন। আমাদের ডারউইনের ক্ষেত্রে বেপারটা এই রকম।’
- সালাহকে ভুলে যাবেন না
যদিও নুনেজ, স্বাভাবিকভাবেই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন এবং শিরোনাম হয়েছিল, এটি ভুলে গেলে চলবে না যে লিভারপুলের আরেক আক্রমণভাগের খেলোয়াড় কিন্তু প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার জিতেছিলেন আর তিনি হলেন সালাহ।
দলের তিনটি গোলেই সালাহ জড়িত ছিলেন, ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ডের প্রথম গোলটি তাঁর দেওয়া পাস থেকেই হয়। পেনাল্টি থেকে নিজেই দ্বিতীয় গোলটি করেন এবং তারপরে রবার্টসন যে ক্রস করেছিলেন তাতে তার বুটের ছোয়া লেগে নুনেজের দিকে যায়। মাঠের ডান প্রান্তে জোয়াও ক্যানসেলোকে তিনি বারবার পরাস্ত করেন এবং তাদের মধ্যে হওয়া যুদ্ধে জয়লাভ করেন।
এই গ্রীষ্মেই তিনি লিভারপলের সাথে একটি নতুন তিন বছরের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন যা ক্লাবটিতে তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করেছে। শনিবারের খেলা দেখে সালাহ দল এবং ব্যক্তিগত উভয় ক্ষেত্রেই গৌরবের সন্ধান চালিয়ে যেতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।
সবার মনোযোগ হয়তো এখন নুনেজ এবং হাল্যান্ডের উপর কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের গোল্ডেন বুটের ক্ষেত্রে আপনি এই মিশরীয়কে হিসাবের বাইরে রাখলে বোকামি করবেন।
- নুনেজ কি ফুলহ্যামের সাথে খেলবেন?
সামনের সপ্তাহে ক্র্যাভেন কটেজে ক্লপের একাদশ কি হবে এটাই এখন সবার প্রশ্ন। তিনি শনিবার নুনেজকে তার প্রথম একাদশে রাখেননি এই যুক্তিতে যে রবার্তো ফিরমিনোর প্রেস এবং খেলার ধরণ সিটির বিরুদ্ধে কার্যকর হবে, যা একদম সঠিক সিধান্ত ছিল। ফিরমিনোর একটি বুদ্ধিদীপ্ত পারফরম্যান্স প্রদান করে, এতে প্রমান হয় যে দলে এই ব্রাজিলিয়ানকে এখনও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।
নুনেজ যদিও তার পারফরম্যান্সের কারণে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, ক্লপ কি তাকে ফুলহামের বিপক্ষে প্রথম একাদশে রাখবেন নাকি বদলি হিসেবে নামাবেন? যাদের বিরুদ্ধে তার আরও বেশি জায়গা এবং সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি যেই সিদ্ধান্তই নেন না কেন তিনি কিছু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন এই কারণে যে যদিও এটি শুধুমাত্র একটি ম্যাচ ছিল কিন্তু নতুন মৌসুমের শুরুতেই দল হিসেবে লিভারপুলকে বেশ গোছান মনে হইয়েছে, যা নি:সন্দেহে একটি শুভ লক্ষ্মণ।