হলুদ তারায় আঁকা লাল পতাকা সদর্পে উঁচিয়ে ধরে মেকং নদীর ধারে তখন হো চি মিন ঘোষণা করেছে ভিয়েতনাম কমিউনিস্টের স্বাধীনতা। ক্যারিবীয়ান উপসাগরের তীরে ডেসালিনি আস্ফালন করে ওঠে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভের মঙ্গলধ্বনি। ওয়াশিংটন উঁচিয়ে তোলে লাল-সাদা-নীল পতাকা।
মাউ সে তুং বাতাসে বহমান কমিউনিজমের সৌরভ মেখে চীনা বিপ্লবে আনে লাল রঙের গন্ধ। ইতিহাস বয়ে চলে নিজের মতো। ইতিহাস স্থির নয়, চলমান। চলমান থাকে বিশ্বের এক একটা বিপ্লব আর স্থির হয়ে আছে শুধু রাষ্ট্রনায়কদের হাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ঘটনাগুলো। কেউ পারে কেউ পারে না।
কেউ হারে, কেউ হারে না। এভাবেই বয়ে চলে ইতিহাস। স্রোতের কালপ্রবাহে উদ্বেলিত হয় নীল বিপ্লবের পতাকা। বিন্দু বিন্দু ঘামের পুঞ্জীভূত জলরাশি গড়ে তোলে সিন্ধু সভ্যতার বিশ্বজয়। মেরিনা ড্রাইভের উপকূলের নিশিথ রজনীতে তখন বাজির উল্লাস। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে উল্লাসে মাতোয়ারা এক নীল সভ্যতা।
আর অদূরে উপকূলের প্রান্ত বরাবর রাতের আকাশে তাকিয়ে থাকে সেই সিন্ধু সভ্যতার এক পৃষ্ঠপোষক।তার রক্তে হো চি মিন কিংবা মাউ সে তুং নেই,তার ঘামে নেই ডেসালিনির দাসবিদ্রোহ,নেই ওয়াশিংটনের মর্যাদা। সেও বিদ্রোহী ছিল।কিন্তু তার ঘটনাপুঞ্জকে ‘বিদ্রোহ’ বলা হয় না। বলে ‘বিপ্লব’।
‘Revolt changes Country but Revolution changes Civilization’। সেদিন নীল বিপ্লবের নেতার দৃষ্টির সামনের আকাশটা অনেক মায়াবী ছিল, অনেকটা নৈসর্গিক ছিল, কিন্তু তার পেরিয়ে আসা পিছনের আকাশটা ছিল তমসাচ্ছন্ন। ছিল বেটিং কান্ডের কলঙ্ক, ছিল লবি, ছিল রাজনীতি। আর সেই নীল বিপ্লবীর দুই বলিষ্ঠ কাঁধে উড়ান দিয়েছিল একটা নীল সভ্যতা।
তার দেখানো পথে বিন্দু বিন্দু জলরাশি মিলে তৈরি হয়েছে সিন্ধুসভ্যতা। আর সেই রাত ছিল বড্ড মায়াবী,বড্ড আবেগী। সেই রাত নীল সভ্যতার বিশ্ব জয়ের। আর অদূরে গ্যালারির ঠিক নীচ থেকে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে সভ্যতার বিপ্লবী দেখে যায়, তার হাতে গড়া কাঁদামাটির ছাঁচগুলোর বস্ত্রে-পুষ্পে সজ্জিত হয়ে বিশ্বগন্ধার পূজা পাওয়া।
যে ‘গন্ধে’ সবই আছে, নেই শুধু ‘সৌরভ’। নেই সৌরভ গাঙ্গুলি। সে মায়াবী দৃষ্টিতে জিঘাংসা নেই, আছে তৃপ্তি। অশ্রু নেই, আছে এক অশ্রুবিজয়ী হাসি। না থাকার দু:খ নেই, আছে হাতে গড়া সৃষ্টসভ্যতার বিশ্বজয়ের প্রফুল্ল। সে দৃষ্টি বড়ই রহস্যের। যেন বারেবারে অঘোষিত ঘোষণা করে – ‘আমিও ছিলাম সভ্যতা, তোমাদের সাথে, তোমাদের মাঝে, তোমাদের হয়ে।’
হো চি মিন পেরেছিলেন ভিয়েতনামের পতাকা ছুঁতে। ওয়াশিংটন,ডেসালিনিরা পেরেছিলেন হাতে গড়া স্বাধীনতার পরশ পেতে। আর ইতিহাসে ছিলেন একজন সৌরভ গাঙ্গুলি যাঁর পরশে শ্বেতমৃত্তিকা ‘পরশ পাথর’ হয়েছিল, কিন্তু নিজে পাননি সেই পরশটা। হয়তো দূর আকাশের নীলকন্ঠ হয়ে দেখছিলেন নীল পতাকার চুড়ায় ওঠাটা।
অমৃতের অমরত্বের পুরাণে এই সৌরভরাই তো বারবার নীলকণ্ঠ হয়ে পান করে অন্ধকারের গরলটা। হেসেছিল সভ্যতা আর অদূরে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল বিপ্লব। নীল সভ্যতা সেদিন রাবেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিল – ‘ওই ফুলের আগুন লাগলো “নীল” দিগন্তে।’
আর একশো বছর আগে অজান্তেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেলেছিলেন পরের লাইনটা- ‘বসন্তে “সৌরভের” শিখা জাগল’। সেদিন আকাশে জ্বলেছিল দশকের শ্রেষ্ঠ ঝাড়বাতিটা,আর অদূরে তার দিকে তাকিয়েছিল রক্তিম শতাব্দীর একটা পোড়া দেশলাইকাঠি যে নিজে পুড়ে গিয়ে জ্বালিয়েছিল ঝাড়বাতিটাকে।