জাদুকর ওয়ার্নের মাইলফলক

দূর মহাকাশের কত অজানা কিছু আমাদের বিস্ময় জাগায়। বিস্ময় জাগায় মিশরের পিরামিড কিংবা চীনের প্রাচীর। সেই সাথে বিস্ময়ের মায়াজালে আমাদেরকে বেঁধে রেখেছিলেন শেন ওয়ার্ন। কিংবদন্তি তকমাটা খানিকটা ফিকে হয়ে যায় তাঁর নামের পাশে। বিশেষণ দিয়ে তো একজন শেন ওয়ার্নকে আটকে ফেলা যায় না। তাঁর বিস্তৃতি তো মহাকাশ সমান।

অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটটা সমৃদ্ধ তারকা সব ক্রিকেটারদের দিয়ে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা খুব সম্ভবত শেন ওয়ার্ন। তিনি ছিলেন রীতিমত জাদুকর। তাঁর জাদু মুগ্ধতা ছড়াতো। প্রতিটা ক্রিকেট পাগল ভক্তের চোখের ক্ষুধা মিটানোর জন্যে ওয়ার্নের একটি স্পেলই যেন ছিল যথেষ্ঠ। অস্ট্রেলিয়ার অমন বাউন্সি আর পেস সহায়ক উইকেটেও প্রলয়কারী ঘূর্ণনের সৃষ্টি করা যায়, সেটার প্রভাবক খুব সম্ভবত তিনিই।

শতশত উইকেট নিয়েছেন তিনি স্পিনের জন্যে বৈরি সব উইকেটে। পিচ কন্ডিশন যে স্রেফ একটা বাহানা সেটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন অজিদের ঘূর্ণি জাদুকর। এমন করেই তো তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব মিলিয়ে ১০০১ উইকেট। টেস্টেই উইকেট শিকারের সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি।

২০০৫ সালের এমনই কোন এক দিনে। অর্থাৎ ১১ আগস্ট ওয়ার্ন করেছিলেন বিশ্বরেকর্ড। প্রথম কোন বোলার হিসেবে টেস্টে ৬০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়ে দেখেছিলেন ওয়ার্ন। তাঁর আগে বহু বাঘাবাঘা বোলার ক্রিকেট ইতিহাসকে মজবুত করেছেন, ক্রিকেটের দর্শকদের পুলকিত করেছেন। তবে ওয়ার্ন যেন সবার থেকেই আলাদা। তিনি ছিলেন অনন্য।

ওয়ার্নের ইতিহাস গড়ার ম্যাচটা ছিল অ্যাশেজের এক ম্যাচ। ইংল্যান্ডের মাটিতে সেবার খেলাটা হয়েছিল ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড স্টেডিয়ামে। ছয়শতম উইকেট হিসেবে ওয়ার্ন শিকার করেছিলেন ইংল্যান্ডের তৎকালীন ওপেনার মার্কাস ট্রেসকোথিকের উইকেট। সেদিনের বলটাও ঠিক যেন ছিল শতক সেরার বলের মতই ঘূর্ণন হওয়া এক বল।

অফ স্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করিয়েছিলেন ওয়ার্ন। এর আগেই মাইকেল ভনকে সাথে নিয়ে ট্রেসকোথিক সাবলীলভাবে রান সংগ্রহ করে যাচ্ছিলেন। অ্যান্ড্রু স্ট্রস আউট হয়ে যাওয়ার পর থেকে ভন-ট্রেসকোথিক জুটি সংগ্রহ করেছিল ১৩৭ রান। রীতিমত গলার কাটা বনে যাচ্ছিল সে জুটি। শেন ওয়ার্ন ঠিক গলার কাটা বেশিক্ষণ আর রাখতে চাইলেন না।

তিনি দেখালেন জাদুর ভেলকি। সে ভেলকিতেই কুপকাত ট্রেসকোথিক। স্টেডিয়াম ভরা দর্শক উজ্জ্বল সেদিনে আবারও মুগ্ধ নয়নে অপলক চেয়ে দেখল ওয়ার্ন জাদু। জাদুকরের হাত থেকে বের হওয়া বলটা অফ স্ট্যাম্পের বেশ বাইরে পরে বাঁক খেয়ে লেগ স্ট্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ট্রেসকোথিক সে বলের ঘূর্ণন ঠিক আন্দাজ করতে পারেননি।

খেলতে চেয়েছিলেন সুইপ শট। তবে ব্যাটে বলে সংযোগটা ঠিক হলো না। তবে জাদুকরের বল একটা খোঁচা আদায় করে নিয়েছিল। এরপর বলটা মাটিতে স্পর্শ করেনি আর। একটা গোলক ধাধার মধ্যে আটকে ছিল কয়েক সেকেন্ড। ব্যাট, গ্লাবস, প্যাড এতসবকিছু সাথে মোলাকাত হয় বলের। তবুও জাদু মিশ্রিত সে বল যেন কোন বাধাতেই দমে যাবে না। ছোঁবে না ধুলো মাটি।

সে বল গিয়ে আবার আঘাত করল অস্ট্রেলিয়ার উইকেট রক্ষক অ্যাডাম গিলক্রিস্টের উরু। তারপর ঠিকই ওয়ার্নের সে বল খুঁজে নেয় গিলির দস্তানা। ক্রিকইনফো সে বলের বিবরণে লেখেছিল যে ঈশ্বরই জানে সে বল আর কোথায় কোথায় স্পর্শ করেছিল। এমন এক অভাবনীয় উইকেটই সেদিন তুলে নিয়েছিলেন শেন ওয়ার্ন। আর তাতেই কাটাছেড়া করে নিজে নামটি লিখিয়ে নেন ইতিহাসের পাতায়।

কথায় আছে ‘কীর্তিমানে মৃত্যু নাই’। তাই শেন ওয়ার্নের এমন কীর্তির স্মৃতিচারণ বছর ঘুরে কয়েকশবার আসবে সামনে নিশ্চয়ই। ক্রিকেটের মৃত্যুতে হয়ত থামবে শেন ওয়ার্ন চর্চা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link