রূপকথার সারথী: ভার্সন ২০০৬

২০০৬ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ। সে আসরের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ক্রিকেটের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত আর পাকিস্তান। এ দুই দেশের লড়াই যে ক্রিকেটের সেই আদিকাল থেকে তা অল্পবিস্তর সবারই জানা৷ তাই হোক যুবাদের লড়াই, তবুও সে ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনা, উন্মাদনার কোনো কমতি ছিল না। লো স্কোরিং ফাইনাল হলেও লড়াইটা জমেছিল বেশ।

পাকিস্তান ১০৯ রানে অল আউট হওয়ায় এক প্রকার ধরেই নেওয়া হয়েছিল যুবাদের বিশ্বকাপটা ভারতের দুর্গেই যাচ্ছে। এরকমটা মনে না হওয়ার কারণই বরং সে সময়ে বিস্ময়কর একটা ভাবনা হতো। কারণ গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচেই ভারত জিতেছিল বড় ব্যবধানে। প্রথম ম্যাচটিতে ৯ উইকেটে এবং পরের দুটি ম্যাচই জিতেছিল ৮ উইকেটে। আর কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১২৬ রানে হারানোর পরে সেমিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল ২৩৪ রানের বিশাল ব্যবধানে। বলে রাখা ভাল, সেবার ইংল্যান্ড যুবাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মইন আলী।

যাহোক, টানা ৫ ম্যাচের অপরাজেয়, উড়ন্ত ভারত সেবারের ফাইনালটা শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি। ১১০ রানের সহজ টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৯ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে সর্বনাশার শুরু। এরপরে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি ভারত।

পিযুষ চাওলা আর পিনাল শাহ মিলে কিছু প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান জিতেছিল ৩৮ রানে। দুই দল মিলে স্কোরবোর্ডে মাত্র ১৮০ রান জমা করলেও বোলারদের লড়াইয়ে ম্যাচের আমেজটা ঠিকঠাকই ছিল৷ ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন আনোয়ার আলী। আর পুরো আসরে ৩৪৯ রান করে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন চেতেশ্বর পূজারা।

ভারত-পাকিস্তান মধ্যকার সে ফাইনালের সালতামামি এতটুকুই। যুব বিশ্বকাপ খেলা ক্রিকেটারদের বলা হয় আগামীর উদীয়মান তারকা। কৌতূহলমনে তাই প্রশ্ন জাগে, সে সময়ের ১৮/১৯ বছরের তরুণরা এখন কোথায় আছেন? ক্রিকেটার হিসেবে পরবর্তীতে কতটা খ্যাতি পেয়েছিলেন? নাকি প্রত্যাশার চাপে কেউ কেউ নুয়ে পড়েছেন?

অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ থেকে উঠে আসা ক্রিকেটারের সংখ্যাটা বেশ বড়। আবার যতটা আশা করা হয়েছিল ততটা মেটাতে ব্যর্থ ক্রিকেটারের সংখ্যাও নগণ্য না। আজকের প্রসঙ্গ তেমনই একটা বিশ্বকাপ – ২০০৬ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ। আচ্ছা সেই বিশ্বকাপে খেলা ভারতীয় স্কোয়াড এখন কোথায়? সে বিশ্বকাপে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রবিকান্ত শুকলা। শুরুটা তাই তাকে নিয়েই করা যাক।

  • রবিকান্ত শুকলা

ক্রিকেটে ‘লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ বলতে যে একটা টার্ম আছে সে আসরে তার সম্পূর্ণটাই বিপরীতে ছিলেন রবিকান্ত শুকলা। পুরো টুর্নামেন্টে খেলা ৫ ইনিংসে করেছিলেন মাত্র ৫৩ রান। যুবা বিশ্বকাপের ফর্মের মতোই পরবর্তীতে আর সেভাবে ক্যারিয়ার এগোয়নি তার। ২০১৩/১৪ পর্যন্ত খেলে গিয়েছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। আর সীমিত ওভারের ক্রিকেটে কখনোই সেঞ্চুরির দেখা পাননি তিনি।

  • পিনাল শাহ

খেলেছিলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে। সে আসরে সর্বাধিক ডিসমিশালের রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি(১৪ টি)। পরবর্তীতে পিনাল শাহ বারোদার হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলে গিয়েছেন। ২০১০-১১ মৌসুমে বারোদা ফাইনালে গিয়েছিল তার নেতৃত্বেই।

  • রোহিত শর্মা

বর্তমান সময়ে সেরা ওপেনারদের নাম করতে গেলে তার নামটাই যথেষ্ট। ভারতের বর্তমান অধিনায়ক উঠে এসেছিলেন এই অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ দিয়েই। সে টূণামেন্টে ৫ ইনিংসে করেছিলেন ২০৮ রান। ব্যাটিংয়ে দারুণ টেকনিকের কারণে খুব দ্রুতই মিলেছিল জাতীয় দলে সুযোগ।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ছিলেন ভারতের স্কোয়াডে। এ ছাড়া অধিনায়ক রোহিত শর্মা কতটা সফল তা তো আইপিএলের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের হয়ে জিতেছেন ৫ আইপিএল শিরোপা। বর্তমানে ভরতকে সামলাচ্ছেন তিন ফরম্যাটেই। তবে কি টানা ৯ বছর ধরে আইসিসি’র কোনো ট্রফি না জেতা ভারতের ভাগ্য ফিরবে রোহিত শর্মার হাত ধরে?

  • রবীন্দ্র জাদেজা

২০০৬ যুব বিশ্বকাপের পরে ২০০৮ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপেও খেলেছিলেন রবীন্দ্র জাদেজা। সেবার অবশ্য আগের ফাইনাল হারের তিক্ততা নিয়ে ফিরতে হয়নি জাদেজাকে। ভারতে ফিরেছিলেন ২০০৮ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য হয়ে।

এ জাদেজাই সময়ের সাথে নিজেকে পরবর্তীতে ভারতের সেরা অলরাউন্ডারে পরিণত করেন। তিনি এখন শুধু ভারতের সেরা অলরাউন্ডার নন, গোটা টেস্ট ফরম্যাটেরই বর্তমান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।

  • চেতেশ্বর পূজারা

সেবার টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছিলেন তিনি। প্রায় ১১৭ গড় ৩৪৯ করা পুজারা অবশ্য ফাইনাল ম্যাচে ফিরেছিলেন শূণ্য রানে। তবে সেই পুজারাই পরবর্তীতে ভারতের টেস্ট দলে হয়ে ওঠেন অপরিহার্য সদস্য।

এখনো খেলে যাচ্ছেন অবিরাম গতিতে। ভারতের হয়ে শুধু টেস্ট খেলা পুজারা তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে হাঁকিয়েছেন ১৭ টা ডাবল! যা ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ!

  • পিযুষ চাওলা

পুরো টুর্নামেন্টে ১৩ উইকেট নেওয়া চাওলা যুব বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই ভারতের হয়ে টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে ভারতের হয়ে পরবর্তীতে আর এ দ্যুতি ছড়াতে পারেননি তিনি। যদিও ২০০৭ টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ আর ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ- দুটিতেই ভারতের স্কোয়াডে ছিলেন তিনি।

ভারতের হয়ে অনিয়মিত থাকলেও আইপিএলে চাওলা ছিলেন দারুণ পটেনশিয়াল ক্রিকেটার। এখন পর্যন্ত আইপিএলের পঞ্চম সর্বাধিক উইকেট শিকারী বোলার তিনি।

  • শাহবাজ নাদিম

২০০৬ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিলেন একটি ম্যাচে। পরবর্তীতে ঝড়খন্ডের হয়ে খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। ২০১৮/১৯ মৌসুমে রাজস্থানের বিপক্ষে তার গড়া ১০ রানে ৮ উইকেটের ফিগারটা ভারতের লিস্ট এ ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত সেরা বোলিং ফিগার।

শাহবাজ নাদিম খেলেছেন আইপিএলেও। দিল্লী ডেয়ারডেভিলস আর সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে সব মিলিয়ে খেলেছেন ৭২ টি আইপিএল ম্যাচ।

  • গৌরব ধীমান

পেসার গৌরব ধীমান ২০০৬ যুব বিশ্বকাপে মূলত চমক দেখিয়েছিলেন ব্যাটিংয়ে। ১২৩ স্ট্রাইক রেটে পুরো টূর্ণামেন্টে করেছিলেন ২২২ রান, সাথে নিয়েছিলেন ৪ টি উইকেট। সে সময়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের ভবিষ্যৎ তারকা বলে বিবেচনা করা হতো ধিমানকে।

কিন্তু, তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় একটি ইঞ্জুরি। এক ইঞ্জুরির কারণে হারিয়ে ফেলেন পুরো একটি মৌসুম। আর এতেই পিছিয়ে পড়েন তিনি। মুম্বাই আর ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে পরবর্তীতে আইপিএলে সুযোগ পেলেও খেলতে পারেননি একটি ম্যাচেও।

  • মায়াঙ্ক তেহলান

মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করতেন তেহলান। সে বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে করেছিলেন ৯৭ রান। পরের বছরেই বারোদার বিপক্ষে রঞ্জি ট্রফিতে ডাবল সেঞ্চুরি করে আলোচনায় আসেন৷ তবে ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সফলতা মিলেছিল ঐ পর্যন্তই। এরপরে টানা ব্যর্থতার কারণে ২০১১ সালের পরে আর রঞ্জি ট্রফি খেলারই সুযোগ পাননি তিনি।

  • দেবব্রত দাস

সে সময়ের সতীর্থ মায়াঙ্ক তেহলানের মতো মিডল অর্ডারেই ব্যাটিং করতেন দেবব্রত দাস। ২০১৩ পর্যন্ত আইপিএলের দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলেছেন। খেলেছেন ডিপিএলের দল ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়েও।

  • আবু নাসিম আহমেদ

বোলিংয়ে দারুণ সুইং করার সক্ষমতা ছিল তার। যুব বিশ্বকাপের সে আসরে ১০ উইকেট নেওয়া নাসিম পরবর্তীতে আইসিএলে নাম লেখান। যদিও এক মৌসুম পরেই আইপিএল খেলার জন্য সেখান থেকে সরে আসেন দ্রুতই। আইপিএলে সব মিলিয়ে ম্যাচ খেলেছেন ১৭ টা।

  • বিজয়কুমার মহেশ

২০০৬ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে ভারতের বোলিং লাইনআপে অন্যতম ভরসার নাম ছিল মহেশ। পুরো টূর্ণামেন্টে পেয়েছিলেন ১১ টি উইকেট। মহেশ বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংও করতে পারতেন। যদিও পরবর্তীতে আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হন তিনি। ২০১৭ পর্যন্ত খেলেছেন তামিল নাডুর হয়ে। গত বছরে খেলেছিলেন আবুধাবি টি-টোয়েন্টি লিগেও।

  • মহনিশ পার্মার

অফ ব্রেক বোলিং করতেন মহনিশ। গুজরাটের হয়ে এক মৌসুমে ২০ ম্যাচে নিয়েছিলেন ৯২ টি উইকেট। তবে পরবর্তীতে অবৈধ বোলিং একশনের কারণে ২০১১ সালের পরে আর কখনোই পেশাদার ক্রিকেটে দেখা যায়নি তাকে।

  • সৌরভ বান্দকার

মিডিয়াম ফাস্ট বোলিং আর শেষ দিকে টুকটাক ব্যাটিং করতে পারতেন সৌরভ বান্দকার। ২০০৬ যুব বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। পরবর্তীতে গোয়ার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে গেছেন প্রায় ১০ বছর। লিস্ট এ ক্রিকেটে তার দুটি সেঞ্চুরিও রয়েছে।

  • ইশান্ত শর্মা

সেই অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের পর কালক্রমে ভারতের হয়ে সবগুলো ফরম্যাটেই খেলেছেন ইশান্ত শর্মা। ফাস্ট বোলার। তবে, সবচেয়ে সফল ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে।

কিছুদিন আগেও টেস্টে ভারতের এক নম্বর বোলার ছিলেন তিনি। যদিও, এখন অনেকটাই ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন। আইপিএলের দলগুলোও তাঁর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link