ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীও বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন পর্যন্ত চারবার এই দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়েছিল। শুধু সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে নয়, বরং সব দিক দিয়েই একে অপরের চেয়ে সেরা হতে চায় প্রতিবেশী এই দুই দেশ। একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এই যে মানসিকতা – এটিই ক্রিকেটের মাঠে পাক-ভারত লড়াইকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।
ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচে লাখ লাখ মানুষের আবেগ জড়িত থাকে। এই ম্যাচে একটা ভাল পারফরম্যান্স যে কাউকে জাতীয় নায়কে পরিণত করতে পারে। আবার উল্টো হলে অর্থাৎ দল হারলে কিংবা বাজে পারফরম্যান্স করলে হতে হয় ভিলেন। কখনো কখনো ভেসে আসে মৃত্যুর হুমকি।
কিন্তু ইন্দো-পাক দ্বৈরথ নিয়ে অদ্ভুত পাগলামি সময়ের সাথে সাথে কমে এসেছে। বিশ শতকের শেষ দিক থেকে একুশ শতাব্দীর শুরুর দশক পর্যন্ত এই ম্যাচ নিয়ে যতটা উত্তেজনার স্ফূলিঙ্গ ছড়াতো সেটাও কমে এসেছে।
আর এটির পেছনে প্রধান কারন নি:সন্দেহে ম্যাচ সংখ্যা কমে আসা। ২০০৭ সালের পর থেকে ভারত এবং পাকিস্তানের মাঝে কোন দ্বিপাক্ষিক সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে নিয়মিত দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বৈরথ দেখার সুযোগ হয় না নতুন দিনের ক্রিকেট ভক্তদের। শুধুমাত্র বিশ্বকাপ কিংবা এশিয়া কাপের মত বড় বড় টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ দেখা যায়।
ম্যাচ সংখ্যা কমলেও অবশ্য বড় আসরে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হলেই সৃষ্টি হয় উন্মাদনা। কিন্তু ম্যাচের আগ পর্যন্ত-ই, মাঠের লড়াই শুরু হলে কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যায়। শচীন টেন্ডুলকার, শোয়েব আক্তার, ওয়াসিম আকরাম কিংবা রাহুল দ্রাবিড়রা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তেন; সমানে সমানে লড়াই করতেন সেটা এখন অনুপস্থিত।
২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল এবং ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তান জিতেছে বড় ব্যবধানেই। ব্যাটাররা পারফর্ম করেছে ঠিকই, তবে দলের জয়ে মূল অবদান রেখেছেন বোলাররা। স্পষ্ট করে বললে দুই বাঁ-হাতি পেসার মোহাম্মদ আমির এবং শাহিন শাহ আফ্রিদি এই দুই জয়ের নায়ক।
কিন্তু এই দুইটি ম্যাচ বাদ দিলে ভারতের আধিপত্য চোখে পড়বে। সবমিলিয়ে হেড টু হেডে এখনো টেস্ট এবং ওয়ানডেতে পাকিস্তান এগিয়ে; কিন্তু গত এক যুগের হিসেবে ভারতের ধারে কাছেও নেই দলটি। একটা সময় ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করা পাকিস্তান এখন অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছে।
অবশ্য পাকিস্তান পিছিয়েছে যতটুকু, তারচেয়ে বেশি এগিয়েছে ভারত। নিজেদের দুর্বলতার জায়গা গুলো কাজ করেছে তারা, নিজেদের শক্তিমত্তা আরো বাড়িয়েছে। একটা সময় ভারতে মানসম্মত ফাস্ট বোলারের অভাব ছিল। গড় পরতা বোলার দিয়েই তাই লম্বা একটা সময় আক্রমণ সাজাতে হতো তাদের।
কিন্তু মহেন্দ্র সিং ধোনি অধিনায়ক হওয়ার পরে শুরু হয়েছিল পেস বিপ্লব। এখন তো বিশ্বের অন্যতম সেরা পেস-ব্যাটারি ভারতীয়দের। জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ শামী, ভুবনেশ্বর কুমারদের সাথে আছেন মোহাম্মদ সিরাজ, উমেশ যাদব, হার্শাল প্যাটেলরা।
আবার দুর্দান্ত ব্যাটিং লাইনআপ অতীতের মত এখনো আছে ভারতের। রোহিত শর্মা, ভিরাট কোহলি, চেতেশ্বর পুজারাদের সাথে আছেন সূর্যকুমার যাদব, রিশভ পন্থ, শ্রেয়াস আইয়ার। সবমিলিয়ে ভারত এখন অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ।
অন্যদিকে ভালমানের পেসার তৈরির জন্য খ্যাতি ছিল পাকিস্তানের। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আক্তারদের একাই ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা ছিল। কিন্তু কয়েকজন স্টাইলিশ ব্যাটার সত্ত্বেও সর্বোপরি এই ব্যাটিং বিভাগ-ই প্রায় ভোগাতো তাদের।
তবে ভারতের মত তারা নিজেদের দুর্বলতা নিয়ে খুব একটা কাজ করেনি। ২০১০ বা এরপরের পাঁচ-সাত বছরে বলার মত শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ ছিল না পাকিস্তানের। তবে বোলিংয়ে আগের মতই ক্ষুরধার আছে তাঁর।
এছাড়া ফিটনেস ইস্যু একটা বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে দুই দলের মাঝে। ভারতীয় দল নির্বাচনে প্রতিভার চেয়ে ফিটনেসের দিকে বেশি জোর দেয়া হয়। এর ফলে ব্যাটিংয়ে ডাবলকে সিঙ্গেল কিংবা সিঙ্গেলকে ডাবল রানে পরিণত করতে পারে তারা। সবমিলিয়ে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে ৩০/৪০ রান বলতে গেলে বাড়তি আদায় করে নেয় ভারত।
একইভাবে ফিল্ডিংয়ে আরো ক্ষীপ্র রোহিত শর্মার দল। দারুণ ফিল্ডিং আর ক্যাচিংয়ে প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে আছে তারা।
ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের শিবিরে। শারিরীকভাবে ফিট থাকার ব্যাপারে পাকিস্তানিদের উদাসীনতা প্রকট। সাবেক অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদের কথাই ধরা যাক। ‘বিলো এভারেজ’ ফিটনেস নিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে গিয়েছেন তিনি। এমনকি ক্যামেরার সামনে তাকে হাই তুলতেও দেখা গিয়েছে।
অবশ্য দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে। বর্তমান সময়ে তিন ফরম্যাটের সবচেয়ে ইনফর্ম ব্যাটসম্যান বাবর আজম পাকিস্তানের অধিনায়ক। এছাড়া ইমাম উল হক, আবদুল্লাহ শফিক, মোহাম্মদ রিজওয়ানদের মত বিশ্বমানের ব্যাটাররা এগিয়ে এসেছেন পাকিস্তানের হাল ধরতে।
ফিটনেসের ব্যাপারেও এখন সচেতন পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা। সবমিলিয়ে পুনরায় ক্রিকেটের পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে বদ্ধপরিকর তারা। অন্যদিকে ভারত সবসময়ই সেরা দলগুলোর একটি।
আর তাই প্রত্যাশা করা যায় যে, শীঘ্রই হয়তো ভারত-পাকিস্তানের পুরোনো সেই ম্যাচগুলো ফিরবে। হয়তো আসন্ন এশিয়া কাপ কিংবা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দর্শকদের রোমাঞ্চে ভরপুর ম্যাচ উপহার দিবে দুই প্রতিবেশী দেশ।