রত্ন চিনতে তিনি ভুল করেননি!

চিতরো ডিয়েগো ম্যারাডোনা এবং ডোনা টোটা ডালমা সালভাডর ফ্রাঙ্কোর তিন কন্যা সন্তানের পর ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। সেদিন কে জানতো বুয়েন্স আইরেসের পলিক্লিনিকো এভিতা হাসপাতালে এই দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া ছোট্ট ছেলেটিই একদিন কালের ব্যবধানে হয়ে উঠবেন মহীরুহু যার বা-পায়ের শৈল্পিক জাদুকরী সৌন্দর্য্যে আলোকিত হবে সমগ্র ফুটবল বিশ্ব!

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন- বলছিলাম ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা এক অমোঘ আশ্চর্য জাদুর নাম যিনি তামাম দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষকে ফুটবলীয় মায়ায় জড়িয়েছেন।

১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনা জুনিয়রসের হয়ে ম্যারাডোনার অভিষেক হয় ক্লাব ফুটবলে। জুনিয়রসের হয়ে ১৬৭ ম্যাচে ১১৫ টি গোল করে আবির্ভাবেই নিজের অস্তিত্বের জানান দেন এ কিংবদন্তি। সেখান থেকে মাত্র চার বছরের মাথায় ১ মিলিয়ন ইউরোতে যোগ দেন বোকা জুনিয়রসে। যদিও সেখানে স্থায়ী হননি, পরের বছর ১৯৮২ বিশ্বকাপের পর রেকর্ড ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনায় যোগ দেন ম্যারাডোনা।

ম্যারাডোনার বার্সেলোনায় যোগদানের সময় ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে তাকে নিয়ে করা একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি। মূলত আরো চার বছর আগে আর্জেন্টিনা জুনিয়রসের হয়ে ম্যারাডোনার বোকা জুনিয়রসের বিপক্ষে খেলা একটি ম্যাচের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন কিংবদন্তি এই কোচ।

তৎকালীন মাত্র ১৭ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি তারকার সকল ফুটবলীয় দক্ষতা ও গুণাবলীকে এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন মেনোত্তি। চলুন দেখে নেয়া যাক কি ছিল সেই প্রতিবেদনে –

খেলোয়াড় রিপোর্ট: ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা

গ্রেড মূল্যায়ন: এক্সট্রা অর্ডিনারি।

গড় গতি: ৯.৫। বলসহ ৯.১, বলছাড়া ৯.৫। ক্ষিপ্রতা- ৯.৫। জাম্পিং দক্ষতা- ৮।

নৈতিক মূল্যায়ন: মানসিক সক্ষমতা- ১০, সহনশীলতা ১০, মনোযোগ-১০, স্বার্থপরতা ০, ব্যক্তিত্ব- ১০।

সাধারণ কলাকৌশল: অপরাজেয়, অদম্য।

বিশেষায়িত কলাকৌশল: লুইস মেনোত্তি তার করা প্রতিবেদনে কিশোর ম্যারাডোনার বিশেষায়িত ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নিচের শব্দগুলো ব্যবহার করেছিলেন।

ড্রিবলিংয়ে অসাধারণ, বিস্ময়কর, কার্যকরী। বল নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ ক্ষমতা, অসামান্য সাহস, অসাধারণ দক্ষতা, খুব ভাল শট, দুর্দান্ত পাসিং, মারাত্বক এ্যাকুরেসি, দূরদৃষ্টি। নেতৃত্বগুণে অসাধারণ। বল ধরে রাখতে, সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে কিংবা হেডিংয়ে অসাধারণ ক্ষমতা।

স্বতন্ত্র কৌশল: সম্পূর্ণই ফুটবলীয় মস্কিষ্কের অধিকারী। খেলাটাকে বুঝার দক্ষতা ও সক্ষমতা অসাধারণ।

সাধারণ সিদ্ধান্ত: সম্ভাবনাময় তরুণ, যিনি ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেছিলেন।  তার রয়েছে অসাধারণ প্রযুক্তিগত গুণাবলী, সহজ ড্রিবলিং ক্ষমতা। প্রতিপক্ষের রক্ষণসীমানার যার গোললাইনের উপর থাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং তিনি জানেন ঐ পরিস্থিতিতে কিভাবে সতীর্থ খেলোয়াড়কে বল দিয়ে তাকে দিয়ে গোল করাতে হয়। মাঠের খেলায় ফুটে উঠে যার  অসাধারণ দক্ষতার প্রতিচ্ছবি।  তিনি অসাধারণ খেলেন এবং দুর্দান্ত দক্ষতার সাথে বলটিকে খুব ভাল নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষিত রাখেন। ক্ষিপ্ত গতির সাথে  তার ড্রিবলিং, ছোট্ট পাস এবং শটগুলি ফুটবল মাঠের আশ্চর্য শৈলী।

জহুরিরই নাকি খাঁটি জহুর চিনতে পারে! হীরায় মোড়ানো ম্যারাডোনাকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি কিংবদন্তি কোচ লুইস মোনেত্তির। কিশোর ম্যারাডোনাকে নিয়ে তিনি যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন কালের পরিকল্পনায় তাঁকে বাস্তবেই রূপদান করেছিলেন ম্যারাডানা, কোথাও কোথাও ছাড়িয়েও গেছেন।

ম্যারাডোনা শুধুমাত্র তার বা পায়ের জাদুতেই মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পেরেছিলেন তামাম দুনিয়ার কোটি কোটি ফুটবল ভক্তবে। ম্যারাডোনা খেলা ছেড়েছেন, ছেড়ে গেছেন এই ভুবনও। কিন্তু ভুবনজোড়া তার কীর্তি অনিঃশেষ, যে জাদুবলে তিনি মুগ্ধ করেছিলেন এই ভুবনবাসিকে তার কখনোই হয়তো হবেনা শেষ। এইখানেই ম্যারাডোনা ব্যতিক্রম, সবার চেয়ে আলাদা।

এই ভুবনে কীর্তিমান একজন ম্যারাডোনাই এসেছিলেন। কীর্তিমানের কি মৃত্যু হয়? একবার চলে গেলেই কি শেষ হওয়া যায়? দিয়াগো আরম্যান্ডো ম্যারাডোনা; মহাপ্রয়াণেও যিনি অমর। মাইলের পর মাইল ব্যাপী বিস্তৃত এই ভুবনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম হাজার হাজার বছরের পরিক্রমায় আমরণ মুগ্ধ থাকবে যাকে ঘিরে।

এখানে একটু বিতর্কও আছে। কেউ কেউ বলেন, মেনোত্তির রিভারপ্লেট প্রীতির কারণে ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত দলে বোকা’র এই কিশোরকে দলে নেয়া হয়নি। যদিও, মেনোত্তি দাবি করেছিলেন, বিশ্বকাপ পরবর্তী যুব বিশ্বকাপের জন্য ফিট রাখতেই যুবদলের মূল অস্ত্র ম্যারাডোনাকে জাতীয় দলে নেওয়া হয়নি। আর দেশের মাটিতে সেবার বিশ্বকাপপ জিততেও অসুবিধা হয়নি ম্যারাডোনার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link