নতুন মৌসুমের শুরুটা মন মতো হয়নি লিভারপুলের। প্রথম ম্যাচে তুলনামূলক দুর্বল ফুলহ্যামের বিপক্ষে ড্র করে তারা, শুরুর হোঁচটটা অঘটন হিসেবেই ধরে নেয় সবাই। কিন্তু পরের ম্যাচেও ঘরের মাঠে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে জিততে ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ধুঁকতে থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে হেরে নিজেদের দৈন্যদশা স্পষ্ট করে তোলে অলরেডরা।
তিন ম্যাচে দুই ড্র আর একটি পরাজয়, গত এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বাজে ভাবে মৌসুম শুরু করেছে লিভারপুল। চিরচেনা ক্লাবটা বদলে গিয়েছে, বদলেছে পারফরম্যান্স আর খেলোয়াড়দের মানসিকতা। কিন্তু দাপুটে দলটার হঠাৎ এমন নেতিবাচক পরিবর্তন কেন – সেটার সম্ভাব্য উত্তরগুলো আলোচনা করা যাক।
- ইনজুরি
ইয়ুর্গেন ক্লপকে সম্ভবত সবচেয়ে অসহায় করে তুলেছে শিষ্যদের ইনজুরি। ইব্রাহিমা কোনাতে, থিয়াগো আলকান্ত্রা, দিয়েগো জোতা, নাবি কেইতা এর মত নিয়মিত একাদশের অনেক খেলোয়াড় ইনজুরির কারনে এখন মাঠের বাইরে। অলরেডদের চোটা-ক্রান্ত খেলোয়াড়দের নিয়েই একটা শক্তিশালী ফুটবল গঠন করা যায়।
তাই তাদের অনুপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই ভোগান্তিতে ফেলেছে ইংলিশ ক্লাবটিকে। এমনকি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ফুটবলারদের সাবস্টিটিউট করার জন্য পরিচিত কাউকে পাননি ক্লপ, বাধ্য হয়েই প্রায় অপরিচিত তরুণদের উপর ভরসা করতে হয়েছে।
- নড়বড়ে মিডফিল্ড
কিছুদিন আগেও নতুন খেলোয়াড় সাইন করানোর ব্যাপারে ইয়ুর্গেন ক্লপ জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দলে কোন ঘাটতি নেই। অথচ নতুন মৌসুমের এক মাস পেরুতেই প্রকাশ পেয়েছে লিভারপুলের অন্যতম বড় দুর্বলতা, তাদের নড়বড়ে মিডফিল্ড। বিশেষ করে স্প্যানিশ থিয়াগো আলকান্ত্রা না থাকায় মিডফিল্ড নিয়ে সমস্যায় পড়েছে তারা।
বর্তমানে স্কোয়াডে থাকা ৯ জন মিডফিল্ডারের মধ্যে চার জনই চোটা-ক্রান্ত। এছাড়া দুইজনের বয়স মাত্র ১৯ আর দুইজন রয়েছেন অফ ফর্মে। লিভারপুল দলে একমাত্র হোল্ডিং মিডফিল্ডার ফ্যাবিনহো এখন ভরসা করার মত সদস্য।
- সেরা খেলোয়াড়দের অফ ফর্ম
ইনজুরি ছাড়াও লিভারপুলের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশ কয়েকজন তারকার অফ ফর্ম। ভার্জিল ভ্যান ডাইক, ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড, অ্যান্ডি রবার্টসন, জর্ডান হেন্ডারসনরা সময়ের অন্যতম সেরা অথচ চলতি মৌসুমে প্রত্যেকে নিজের ছায়া হয়ে আছেন। বিশেষ করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ম্যাচে অলরেডদের ডিফেন্স লাইনের দুর্বলতা বড্ড চোখে লেগেছে।
এছাড়া স্ট্রাইকার রবার্তো ফিরমিনো, গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারছেন না। নিজের প্রিয় শিষ্যদের ফর্মে ফেরানোটা তাই এখন ইয়ুর্গেন ক্লপের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
- সাদিও মানে
লিভারপুলে সাম্প্রতিক সময়ের সাফল্যের রহস্য ছিল ‘টিম’ হয়ে উঠতে পারাটা। বিশেষ করে আক্রমণে সালাহ-মানে জুটি বারবার উদযাপনের উপলক্ষ এনে দিয়েছে সমর্থকদের। কিন্তু সেনেগাল উইঙ্গার বায়ার্ন মিউনিখে চলে যাওয়ার মত আক্রমণভাগে অগোছালো হয়ে পড়েছে লিভারপুল।
তরুণ লুইস দিয়াজ, ডারউইন নুনেজদের উপর বিশ্বাস রাখলেও তারা কেউই এখন পর্যন্ত মানের শূণ্যতা পূরণ করতে পারেননি। আর তাই গোলমুখের সামনে আসলেই দিশাহীন হয়ে পড়েন সালাহ,দিয়াজরা; ভোগেন সিদ্ধান্তহীনতায়।
- স্লো স্টার্ট
খেলা শুরু হওয়ার পর উল্লেখযোগ্য একটা সময় লেগে যায় লিভারপুল খেলোয়াড়দের মানিয়ে নিতে। সর্বশেষ সাতটি লিগ ম্যাচে আগে গোল হজম করা সেটারই প্রমাণ দেয়। তাদের এই ধীরগতির শুরু নিঃসন্দেহে ভাল কোন বার্তা দেয় না।
ফিটনেস কিংবা আত্মবিশ্বাসের অভাব যেকোনো কিছুই দায়ী হতে পারে আর্নল্ডদের এমন অবস্থার জন্য। তবে কারণ যাই হোক, এবারের মৌসুমে ভাল কিছু অর্জন করতে চাইলে দ্রুত এমন সমস্যার সমাধান বের করতেই হবে।
- মানসিকতার পরিবর্তন
গত মৌসুমে লিভারপুল ছিল দুর্দান্ত ফর্মে। তবু মৌসুম শেষে মেজর ট্রফি জিততে ব্যর্থ হয় তারা। এর মাঝে প্রিমিয়ার লিগ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের খুব কাছাকাছি এসেও শেষপর্যন্ত বেদনাকে সঙ্গী করেই মাঠ ছাড়তে হয়েছে। আর এজন্যই হয়তো নতুন মৌসুমে আগের সেই জয়ের ক্ষুধা দেখা যাচ্ছে না অলরেড শিবিরে।
২০২১/২২ মৌসুমে মাত্র ২২ পয়েন্ট হারানো লিভারপুল এবার মাত্র তিন সপ্তাহে সাত পয়েন্ট হারিয়েছে। বল দখলের লড়াই, স্প্রিন্ট কিংবা থ্রু পাস সব ক্ষেত্রেই তাদের ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে এখন।
- অভিশপ্ত সময়
শুনে হাসি পেতে পারে, তবে কখনো কখনো এমন হয়। একটার পর একটা খারাপ ঘটনা ঘটতে থাকে; সব আশঙ্কা একসাথে সত্যি হয়। লিভারপুলের ভাগ্যে এখন হয়তো এমন অভিশপ্ত সময় এসেছে। ইনজুরি, অফ ফর্মের পাশাপাশি দলের সমন্বয়েও দেখা দিয়েছে ঘাটতি।
মাঠেই খেলোয়াড়দের তর্কে জড়াতে দেখা গিয়েছে; কয়েকজনের ক্লাব ছাড়তে চাওয়ার ব্যাপারে গুঞ্জন উঠেছে। অ্যানফিল্ড এখন আর আগের মত গর্জন করেনা, দর্শকদের মাঝে বিরাজ করছে হতাশা।
ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন – নিজেদের খারাপ সময়েও অবশ্য একা হাঁটতে হবে না লিভারপুলকে; ভক্ত-সমর্থকদের সমর্থন সবসময়ই আছে দলটির সাথে। মাত্র তো মৌসুমের শুরু, ঘুরে দাঁড়ানোর একটা উপায় নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবেন জার্মান ট্যাকটিশিয়ান ইয়ুর্গেন ক্লপ; হয়তো একটা জয়, একটা ভাল সপ্তাহ আবারো ফিরিয়ে আনবে পুরোনো সেই অলরেডদের।