গ্রিনিজ থেকে ডোমিঙ্গো: কোচ যায়, ভাগ্য বদলায় না!

বিচ্ছেদ, বিদায় দুটি শব্দকে কি আলাদা করা যায়? ক্রিকেট, ফুটবল কোচদের ক্ষেত্রে হয়তো যায়। গুরু-শিষ্যের তিক্ততায় মিশে যাওয়া সম্পর্ক এক সময় বিচ্ছেদে রূপ নেয়। আর শিষ্যের সাথে গুরুর আত্মিক বন্ধনে কিছু কোচের বিদায় হয় অশ্রুসিক্তময়, বিষণ্ণতায় পূর্ণ। অবশ্য কিছু বিদায় একদমই রঙহীন। ‘ওকে। টাটা, গুড বাই’ বলে বিদায়। একদম সাদামাটা প্রস্থান যাকে বলে। আবার কিছু বিদায় অনেকটা এমন - ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।’

বিচ্ছেদ, বিদায় দুটি শব্দকে কি আলাদা করা যায়? ক্রিকেট, ফুটবল কোচদের ক্ষেত্রে হয়তো যায়। গুরু-শিষ্যের তিক্ততায় মিশে যাওয়া সম্পর্ক এক সময় বিচ্ছেদে রূপ নেয়। আর শিষ্যের সাথে গুরুর আত্মিক বন্ধনে কিছু কোচের বিদায় হয় অশ্রুসিক্তময়, বিষণ্ণতায়  পূর্ণ। অবশ্য কিছু বিদায় একদমই রঙহীন।  ‘ওকে। টাটা, গুড বাই’ বলে বিদায়। একদম সাদামাটা প্রস্থান যাকে বলে। আবার কিছু বিদায় অনেকটা এমন – ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।’

বাংলাদেশ ক্রিকেটে কোচদের প্রস্থান নতুন কিছু নয়। এক কোচ এসেছেন, আবার চলেও গিয়েছেন। ঐ আসা যাওয়ার মধ্যে কেউ কেউ বড় গল্প লিখে গিয়েছেন। সে সব বড় গল্পকে পুঁজি করে এগিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। আবার কেউ কেউ পরিপূর্ণ গল্পের গাঁথুনী গাথতে গিয়ে ছোট গল্প লিখেই বিদায় নিয়েছেন। এসব বিদায়ে কিছু ছিল আবেগ মিশ্রিত আর বেশির ভাগই ছিল আক্ষেপ, অভিযোগে ভরা। অবশ্য আক্ষেপ, অভিযোগ, গোলযোগ বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই যেন সমার্থক রূপ।

সর্বশেষ খবর হলো, রাসেল ডোমিঙ্গো আর বাংলাদেশের কোচ হিসেবে থাকতে চাচ্ছেন না। ২০১৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিতর্ক যেন তার নিত্যদিনের সঙ্গী। অবশ্য বাংলাদেশের প্রায় সব কোচেরই বিদায় হয়েছে বিতর্ককে সাথে রেখে। তবে এমন বিতর্কিত বিদায় প্রথম শুরু হয়েছিল গর্ডন গ্রিনিজের হাত ধরে। ফিরে দেখা যাক গর্ডন গ্রিনিজ থেকে রাসেল ডোমিঙ্গোর সেই সব যাত্রা, কার বিদায় কিভাবে হয়েছে৷

  • গর্ডন গ্রিনিজ

ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তিদের তালিকা করতে গেলে প্রথম সারিতেই থাকবেন গর্ডন গ্রিনিজ। তাই বাংলাদেশের কোচদের ইতিহাসে প্রথম বড় নাম ছিল এই গ্রিনিজ। ১৯৯৬ সালে দায়িত্ব পেয়েই দেখান ঝলক। তার কোচিংয়েই ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো আইসিসি ট্রফির শিরোপার জেতে বাংলাদেশ ৷ একই সাথে তার অধীনেই প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ।

গর্ডন গ্রিনিজ বাংলাদেশ ক্রিকেটে কতটা নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তার প্রমাণ মেলে বহু ঘটনায়। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালে প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচটা যখন আকরাম খান জিতিয়ে ফিরলেন তখন কোচ গ্রিনিজ ড্রেসিংরুমে নিরবে কাঁদছিলেন। কারণ ঐ ম্যাচজয়েই তো ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়৷ তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে এই মানুষটির প্রস্থান হয়েছিল খুবই বাজেভাবে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিনই জানতে পারেন তিনি আর কোচ হিসেবে থাকছেন না।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস এতো দ্রুত তিনি চাননি। এ ছাড়া খেলোয়াড়দের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করার অভিযোগও তোলা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। তাই বিদায়ের সাথে এক প্রকার অপমানকে সঙ্গী করেই বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন গ্রিনিজ। যদিও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব সম্মাননা আর একটি পাসপোর্ট। বিদায়ের এমন তিক্ততাতেও ভাঁটা পড়েনি বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা।

সে পাসপোর্টটি তিনি বুক পকেটে রেখেছিলেন সযত্নে। আর সেই পাসপোর্টটি নিয়েই দীর্ঘ ১৮ বছর পর ২০১৮ সালে গর্ডন গ্রিনিজ এসেছিলেন বাংলাদেশে। কোনো রকম ভিসা ছাড়াই এবার তার পদার্পণ ঘটে বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবে।

  • এডি বারলো

বাংলাদেশ ক্রিকেটে এডি বারলো এক আবেগের নাম। পরিসংখ্যানে বারলোর চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ কোচ বাংলাদেশে এসেছেন, কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে তার আবেগের মাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি কেউ।

বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর এডি বারলো বাংলাদেশকে কোচিং করাতে চেয়েছিলেন অনেকদিন। কিন্তু হঠাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে হারিয়ে ফেলেন চলা ফেরার শক্তি। তাই বাংলাদেশ যখন অভিষেক টেস্ট খেলার ঐতিহাসিক মুহূর্তের দ্বারপ্রান্তে, তখন তিনি বসে ছিলেন হুইলচেয়ারে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে অনুমিতভাবেই এডি বারলোকে বাংলাদেশের কোচ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

  • ট্রেভর চ্যাপেল

গ্রেগ চ্যাপেল আর ইয়ান চ্যাপেল- ক্রিকেট ইতিহাসে এই চ্যাপেল ব্রাদার্স বিখ্যাত এক নাম। এদেরই ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেল ২০০১ সালে বাংলাদেশে আসেন কোচ হয়ে। তবে তার কোচিংয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট খুব একটা সুফল ভোগ করতে পারেনি। বরং বলা হয়ে থাকে, তার কারণেই সে সময়ে বাংলাদেশের পারফর্মেন্স আরো নিম্নগামী হয়। তাই দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় ২০০২ সালেই তাকে কোচ থেকে অপসারণ করা হয়।

  • মহসিন কামাল-আলী জিয়া

২০০২ সালে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন পাকিস্তানের মহসিন কামাল আর তার বন্ধু আলী জিয়া। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একের পর এক দল নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্তে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে বাংলাদেশ দল।

এর ফল বাংলাদেশ দল ভোগ করে ২০০৩ বিশ্বকাপে। বাংলাদেশের স্মরণকালের সবচেয়ে হতাশাজনক বিশ্বকাপের স্মৃতির আবির্ভাব ঘটে এই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দিয়েই। অবশ্য সে বিশ্বকাপের পরই ছেঁটে ফেলা হয় এ দুই কোচকে।

 

  • ডেভ হোয়াটমোর

ডেভ হোয়াটমোর বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক নস্টালজিয়ার নাম। ধুঁকতে থাকা এক বাংলাদেশকে নব শক্তির জোয়ার এনে দেন এই কোচ।

২০০৫ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো টেস্ট জেতে তার অধীনেই। ঐ একই বছরে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে হারায় বাংলাদেশ। এ ছাড়া ২০০৭ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ভারত আর সুপার এইটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারায় হোয়াটমোরের বাংলাদেশ। তবে ২০০৭ বিশ্বকাপের পরই তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

  • জেমি সিডন্স

বাংলাদেশের অন্যতম সফল কোচ ছিলেন জেমি সিডন্স। বিশেষ করে, বাংলাদেশি ব্যাটারদের টেকনিক্যাল দিক দিয়ে উন্নতির পেছনে দারুণ কাজ করেছিলেন সিডন্স। তবে বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে ২০১১ সালে তাকে কোচ থেকে অপসারণ করা হয়।

এরপর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের কোচ হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। হেড কোচ হিসেবে না হলেও জেমি সিডন্স গত বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেটে ফিরেছিলেন ব্যাটিং কোচ হিসেবে। এখনো সে দায়িত্বই পালন করে যাচ্ছেন তিনি।

  • স্টুয়ার্ট ল

সিডন্সের বিদায়ের পরে স্টুয়ার্ট ল বাংলাদেশের কোচ ছিলেন মাত্র ৩ মাস। ঐ ৩ মাসেই নানা বিতর্কে জড়ান তিনি। বিশেষ করে, তার কড়া নিয়মের কারণে ক্রিকেটারদের জন্য এক নাভিশ্বাস পরিবেশ বিরাজ করেছিল সে সময়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার মেয়াদ থাকলেও পারিবারিক কারণে মাত্র ৩ মাসের মাথায় তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান। এরপরে আর বাংলাদশে পা রাখেননি তিনি।

  • রিচার্ড পাইবাস

রিচার্ড পাইবাসের সাথে বিসিবি’র কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছিল না। মাত্র চার মাসের জন্য কোচ ছিলেন তিনি। স্টুয়ার্ট লয়ের মতো তিনিও দায়িত্ব থাকা অবস্থাতেই বাংলাদেশ ছেড়ে যান। যদিও, এখানে বিসিবির চেয়ে পাইবাসের নিজেরই দায়টা বেশি।

  • শেন জার্গেনসেন

স্টুয়ার্ট ল আর রিচার্ড পাইবাসের সহকারী ছিলেন শেন জার্গেনসেন। তারা বিদায় নিলে কোচ করা হয় জার্গেনসেনকে। তবে তার যাত্রাও দীর্ঘ হয়নি। বিসিবিও তাকে আর কোচ হিসেবে দেখতে চায়নি ৷ তাই বলা হয়ে থাকে, তার বিদায়টা পারস্পারিক সমঝোতাতেই হয়েছিল।

  • চান্দিকা হাতুরুসিংহে

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল কোচ কে? এই প্রশ্নের উত্তরে তর্ক সাপেক্ষে চান্দিকা হাতুরুসিংহের নাম আসবেই। ২০১৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন হাথুরুসিংহে। তার তত্বাবধানেই ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। একই সাথে বিশ্বকাপের পরে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ হারানোর কারিগরও ছিলেন তিনি।

তবে হাথুরেসিংহকে বলা হতো কড়া হেডমাস্টার। এজন্য কিছু ক্রিকেটারের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হয়। এছাড়া দলের মধ্যে বেশ কিছু শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তি থাকলেও চুক্তির এক বছর আগেই তিনি বিদায় নেন।

  • স্টিভ রোডস

ফিল সিমন্স, রিচার্ড পাইবাস নাকি স্টিভ রোডস? বাংলাদেশের পরবর্তী কোচ কে হবে- এর দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতের বিশ্বকাপজয়ী কোচ গ্যারি কার্সটেন কে। কারস্টেন স্টিভ রোডসকে সিলেক্ট করেন। জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে এটাই ছিল স্টিভ রোডসের প্রথম অভিজ্ঞতা। অবশ্য তার সময়কালে বাংলাদেশ বেশ সফলই ছিল।

তার সময়েই প্রথমবারের মতো ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। তবুও সে সাফল্য তার কোচিংয়ের সময়কালকে বাড়াতে পারেনি। মূলত ২০১৯ বিশ্বকাপে তার গেমপ্ল্যান নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। ঐ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে তাকে দায়ী করা হয়। এ কারণে বিশ্বকাপের পরেই তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় বিসিবি।

  • রাসেল ডোমিঙ্গো

গুঞ্জণ সত্যি হলে, হয়তো বাংলাদেশের কোচ হিসেবে দেখা যাবে না রাসেল ডোমিঙ্গোকে। সম্ভবত বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে কোচ হিসেবে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার হয়েছেন তিনি। অবশ্য এর জন্য নিজেও তিনি দায়ী। ওয়ানডে ক্রিকেট বাদ দিলে বাকী দুই ফরম্যাটে তিনি ছিলেন মোটাদাগে ব্যর্থ।

এ সময়কালে কোচিং স্টাফসহ ক্রিকেটারদের সাথে তার সম্পর্ক প্রায় তলানিতে ঠেকেছিল। অবশ্য কোচ হিসেবে তার বিদায়ের দাবি সমর্থক পক্ষ থেকে এসেছিল বহু আগে থেকেই। তবে বিসিবি’র সাথে চুক্তির মারপ্যাচে তা আটকে ছিল এতদিন। তবে এবার নিজে থেকেই সরে যাচ্ছেন তিনি। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো ঘোষণা আসেনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...