তারুণ্য, গতি, দলের প্রতি অসীম নিবেদন। এ তিনের মিশেলে পাকিস্তানের নতুন এক সেনসেশনের নাম নাসিম শাহ। অবশ্য ‘নতুন’ বলাটা এক অর্থে ভুল বলা হলো। কারণ সাদা বলের শুরুটা এ বছরে হলেও লাল বলের ক্রিকেটে নাসিম শাহ আছেন ২০১৯ সাল থেকেই। বলে রাখা ভাল, টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সর্ব-কনিষ্ঠতম হ্যাটট্রিকম্যান হলেন এই নাসিম। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর করা সেই হ্যাটট্রিকের ভুক্তভোগী ছিল বাংলাদেশ।
১৯ বছর বয়সী নাসিমের চেহারায় এখনো বেবি ফেসটা কাটেনি। কিন্তু তাতে কী! নিয়মিত ৯০ মাইল গতিতে বল করা নাসিম শাহ যেকোনো দলের ব্যাটিং লাইনআপ গুড়িয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। বাবর আজমের কথাতেও মেলে প্রশংসার সুর।
দলের সেরা পেসার শাহিন শাহ আফ্রিদিকে তিনি মিস করেছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দলের জন্য শাহিন শাহ তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বোলার। তাকে দলে না পাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু নাসিম শাহ যেভাবে ভারতের বিপক্ষে বল করেছে তাতে সত্যি বলতে আমি সেভাবে আফ্রিদিকে মিস করিনি। বলা যেতে পারে নাসিম শাহই ওর অভাবটা বুঝতেই দেয়নি আমাদের।’
সবে মাত্র কৈশোর পেরোনো নাসিম ক্রিকেট বলে বল করা শুরু করেছেন ১৪ বছর বয়সে। শুরুর গল্পটার সূচনা লিখেছিল লাহোরের আব্দুল কাদির ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি। পাকিস্তানের কিংবদন্তি লেগ স্পিনার আব্দুল কাদিরের নামে এ ক্রিকেট একাডেমি টা পরিচালনা করেন তারই পুত্র সুলাইমান৷
নাসিম শাহর বেড়ে ওঠা পাকিস্তানের লোয়ার দির অঞ্চলে। লাহোর থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরের অঞ্চলটি মূলত খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের পাহাড়প্রধান একটি এলাকা। কৃষিকাজ করেই এ এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এ পরিবেশ থেকে বেড়ে ওঠা কঠিন হবে ভেবে ১৪ বছর বয়সেই নাসিম শাহর চাচা তাকে লাহোরে নিয়ে আসেন। এখানে এসে তিনি আব্দুল কাদির ইন্টারন্যামে ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন।
নাসিম শাহর তখন ক্রিকেট খেলার দৌড় টেপ টেনিসে বোলিং করা পর্যন্ত। ক্রিকেট বল তখনো হাতেই নেওয়া হয়নি তাঁর। কিন্তু ক্রিকেট বল হাতে নিয়েই একাডেমির সবাইকে অবাক করে দেন সে সময়ের ১৪ বছর বয়সী নাসিম শাহ। কাদির পুত্র সুলাইমান নাসিমের পেস মুভমেন্ট আর অ্যাকশন দেখে বেশ বিস্মিত হন। কারণ সাধারণত এত কম বয়সে কাউকে এত দ্রুত পেসে বোলিং করতে দেখা যায় না।
সুলাইমানের একাডেমিতে থাকাকালীনই পাকিস্তানের অনূর্ধ্ব ১৬ ক্যাম্পে ডাক পান নাসিম শাহ৷ এর কিছুদিন বাদে স্কোয়াডের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে পাকিস্তানের অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পান তিনি৷ নাসিম শাহ ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই কোচ এবং পরামর্শক হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন সুলাইমানকে। সুলাইমান সবসময় চাইতে, নাসিম শাহ প্রচুর পরিশ্রম করুক যাতে করে টেস্ট ক্রিকেট টেম্পারমেন্টে সে অভ্যস্ত হতে পারে। সুলাইমান নিজেও নাসিমকে টেস্ট ক্রিকেটকে বেশি গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন।
টেস্ট ক্রিকেটে নাসিম সুযোগও পেয়ে যান তাড়াতাড়ি। মাত্র ১৬ বছরেই দলের সাথে অস্ট্রেলিয়া সফরে যান টেস্ট খেলতে। ক্যারিয়ারে প্রথম টেস্ট খেলার মুহূর্ত যে কোনো ক্রিকেটারের জন্যই গর্বিত এক মুহূর্ত। কিন্তু আর দশটা ক্রিকেটারের মতো নাসিম শাহর ক্ষেত্রে এমন মুহূর্ত আসেনি৷ নাসিমের অভিষেকে কিছুদিন আগেই তার মা মারা যায়।
মায়ের মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল পুত্রের মনে তখন বিষণ্ণতার নীল বেদনা। নাসিম শাহ দেশে ফিরে আসতে চাইলেন। কিন্তু গুরু সুলাইমান আর পাকিস্তান ম্যানেজমেন্ট নাসিম শাহকে শোককে শক্তিতে রূপান্তর করার কথা বললেন ৷ নাসিম শাহও অস্ট্রেলিয়ায় থেকে গেলেন। এরপর পাকিস্তানের ২৩৭ তম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হলো সদ্য মা হারানো এক কিশোরের৷
খুব অল্প বয়সে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করা নাসিম শাহ পরবর্তীতে পড়েন ভিন্ন এক সমস্যায়। একের পর এক ইনজুরিতে জর্জরিত হতে থাকেন তিনি। তখনকার কোচ ওয়াকার ইউনুস লক্ষ্য করলেন, নাসিম বল করার সময় সাইড অনে খুব প্রেশার দেন। যার কারণে কাঁধের ইনজুরি একদম অনুমিতই। হয়েছেও তাই। পরের দুই বছরে তিনবার এই একই ইনজুরিতে পড়েন তিনি।
সুলাইমানের মতে, নাসিম শাহর সবচাইতে শক্তিশালী দিক হলো, সে তাঁর নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে অবগত। সেই লক্ষ্যে যাওয়ার জন্য সে দিনের পর দিন কাজ করে যেতে পারে। ইনজুরির পরে নাসিম শাহ ঠিক এমন লক্ষ্য রেখেই কাজ শুরু করেন। একাডেমিতে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার মুদাসসর নজরের ক্যাম্প করেছেন, নিজের দেহ সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন, খাবার, ঘুম এমনকি বোলিং লেন্থ নিয়েও কাজ করেছেন।
এর ফল হাতেনাতে পেয়েছেন নাসিম। মাস দেড়েক আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেকের সিরিজেই নিয়েছেন ৩ ম্যাচে ১০ উইকেট। এর মধ্যে এক ম্যাচ তিনি ৫ উইকেট শিকারও করেছিলেন। মূলত সেই পারফরম্যান্সের কারণেই চলমান এশিয়া কাপ দলে তাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এরপর এখানেও দ্যুতি ছড়াচ্ছেন তিনি। প্রথম ২ ম্যাচেই নিয়েছেন ৪ উইকেট।
নাসিম শাহর বয়স সবেমাত্র উনিশ। সামনে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে দারুণ সব সম্ভাবনা। তবে সম্ভাবনার সেই দুয়ারগুলো তাকে নিজেই খুলতে হবে। আপাতত দলের প্রতি যে নিবেদন আর শ্রম তিনি দেখিয়েছেন তাতে সামনের সময়ে বরং তাঁর ছন্দ পতন হলেই বিস্ময় জাগানিয়া ব্যাপার হয়ে যাবে। পাকিস্তানও নিশ্চয় দারুণ এই সম্পদকে তাঁদের ‘নক্ষত্র পতন’ ফ্রেমে ফ্রেমবন্দী করতে চায় না।