পাপন ভাই, আর কত!

শেরে বাংলার একটা উক্তি খুব বিখ্যাত। উনি আনন্দবাজার নিয়ে বলেছিলেন। আনন্দবাজার যদি সমালোচনা করেন, তার মানে উনি ঠিক পথেই আছেন। দেশ বিভাগের পর যদি ও সেই সমালোচনাতে ভাঁটা পরেছে। কালে-ভদ্রে বাংলাদেশের খবর আমাদের প্রতিবেশির কাছে যায়, তাও দুর্বলতা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে। আর তাদের শেষ এক্সক্লুসিভ ছিল- নাজমুল হাসান পাপনকে নিয়ে ‘হাসান রাজা’ নামকরন। হাসান রাজা বলে পাকিস্তানি একজন খেলোয়াড় ছিলেন যিনি চমক দিয়ে আসলেও, চরম ব্যর্থ হন।

ক্রিকেট খেলাতে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নাম সাকিব আল হাসান। কিন্ত বাংলাদেশের মুখ এখন আর উনি নাই। আমাদের সভাপতি সাহেব তার সব কিছুর ভুমিকার জন্য ক্রিকইনফো, ক্রিকবাজসহ সব ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট পোর্টালে হিট। এখন ভারত, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের ক্রিকেট ভক্ত বন্ধু-বান্ধবরা ও বাংলাদেশ নিয়ে মজা নেয়। নিবেই না কেন? আমাদের সব কাজ শুধু মাত্র দুইজন করেন, বাকি বোর্ড ডিরেক্টরদের দেখা যায় শুধু বিদেশ ভ্রমনেই ব্যস্ত। আদমশুমারী অনুসারে ১৬ কোটির দেশে দুইজনই যদি সব করতে পারে, এত বড় বোর্ড যা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড বা ইংল্যান্ড থেকেও বড়, তা নিয়ে আমরা কি করব?

আপনি দেশের সব থেকে বেশি সময় ধরে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। সাথে আপনি ক্লাবের সাথে ও জড়িত, জড়িত দেশের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথেও, আপনি জনপ্রতিনিধিও। আপনি আইবিএ থেকে এমবিএ করা, পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট সাহবের ফ্যামিলি শিক্ষা। আপনার তো জানার কথা, আধুনিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম টিকে থাকে ওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউশনের উপর। একজন প্রধান নির্বাহীর তো কখনো লেবারের কাজ দেখার দরকার হয় না, কিন্তু আপনি একাধারে দল নির্বাচন থেকে সব কিছু করেন।

সব কিছু একমুখী করে রেখে দিয়েছেন। আপনার সব থেকে কাছে থাকেন খালেদ মাহমুদ সুজন। বোর্ডের ডিরেক্টর হয়েও যিনি এখনো ক্লাবের কোচিং ছাড়তে পারলেন না। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের পাতানো খেলার জন্য তাই আংগুল ওনার দিকেই যায়। তাও বা বলে লাভ কি! মোহাম্মদ আশরাফুলের ঘটনার সময়ে ও পেপারে ওনার নাম এসেছিল, কিন্তু সব চেপে গেলো। আপনার হাতে আর কেউ কি নেই একেবারে? কেন তাহলে ফারুক আহমেদ বাংলাদেশের সেরা নির্বাচক হয়ে টিকতে পারলো না, স্টিভ রোডস দেশে আসা অন্যতম সেরা কোচ, হিথ স্ট্রিক (উনি নিজেই থাকেননি), সাকলায়েন মুশতাক সেরা স্পিন কোচ বা দেশের সেরা কোচ সালাউদ্দীন কেন কোচিং প্যানেলে থাকতে পারেন না।

থাকতে পারেননি সবার শ্রদ্ধেয় কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম, অন্যতম সংগঠক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বা আসতে পারছে না ক্রিকেট আইকন মাশরাফি বিন মুর্তজা। খালেদ মাহমুদ যদি সবার সেরাই হন, উনি সাউথ আফ্রিকা বা ইংল্যান্ডে গিয়ে কোচিং করাক, কেন অন্যদের পথ বন্ধ করে দিয়েছেন? বলবেন- বাংলাদেশের পারে না? ভুল, আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে দেখেন? যে পারে, সে সব জায়গায় পারে, পাতানো ম্যাচ খেলে লিগ জেতা লাগে না।

রেকর্ড বলে আপনি বাংলাদেশের সব চেয়ে সফল বিসিবি প্রধান, কিন্তু যে টিমের উপর দাঁড়িয়ে সফলতা তারা তো সেই ২০০৭ বিশ্বকাপ ব্যাচের। আপনার সময়ের ক্রিকেটার কই? এখনো তো মুশফিক বা রিয়াদকে প্রেসার দিতে পারে সেইরকম প্লেয়ার তো নাই। মাশরাফি বিন ‍মুর্তজা যাওয়ার পর তার স্পেস পুরন করতে পেরেছে এরকম কাউকে কি দেখাতে পারবেন? অনেক প্রতিভা নিয়ে এসেও নাসির হারিয়ে গেলো, মুমিনুলকে ওয়ান ডে তে সুযোগই দেয়া হলো না, মোসাদ্দেকের টেস্ট প্রতিভা নষ্ট করে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান বানিয়ে ফেলা হচ্ছে- এগুলো বলতে গেলে অনেক কথা হবে। এক লিটনের বিকল্প দেখান, বাকিদের কথা বাদই দিলাম।

দেশে বিভাগীয় পর্যায়ে ক্রিকেট মাঠ আছে, কিন্ত নাই পীচ। পীচ নিয়ে হাহাকার আমাদের সেই অনেক আগে থেকেই। কিন্তু সাময়িক সাফল্যের মোহে স্লো পীচ বানিয়ে সব ব্যাটসম্যানদের টেকনিকই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বলবেন মাটি খারাপ? তাহলে ভারত কিভাবে তাদের রঞ্জি ট্রফির সব পিচ বদলে ফেললো? সব থেকে বড় মাঠ বানানোর বাজেট আপনার আছে, কিন্তু পীচ ঠিক করার কোন ইচ্ছা নাই। যদি এত মাঠের মধ্যে ৬ টা মাঠের পিচ ঠিক করতে না পারেন- এটা কোন যুক্তিতে চলে? ক্রিকেটারদের আন্দোলনে দেশের সব সমস্যাগুলো উঠে এসেছিলো, বাস্তবতা হচ্ছে ওদের বেতন বাড়ানো ছাড়া আর কোন দাবিই পূরণ হয়নি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন সব কিছুতে খরচ কমাতে বলেছেন- তখন বিসিবি কি সেই নির্দেশ মানছে? তাহলে এত বিশাল লটবহর কি নিজের খরচে এশিয়া কাপ দেখতে গিয়েছে নাকি বিসিবের খরচে? স্ট্রাকচারাল অপ্রয়োজনীয় ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কও কিন্তু বন্ধ হয় নাই। আচ্ছা আপনাদের অডিট রিপোর্ট কি মানুষের সামনে প্রকাশ করতে পারবেন? বিশ্বের চতুর্থ ধনী ক্রিকেট বোর্ডের যদি কোন জবাবদিহীতা না থাকে কিভাবে চলবে? কিছু কিছু জিনিস সামনে আসে বাইরের কোচ চলে যাওয়ার আগে ইন্টারভিউ দিলে অথবা রিটায়ার্ড ক্রিকেটাররা যদি কিছু বলে। তাও তো মাশরাফির একাত্তর টিভির ওই এক্সক্লুসিভ প্রচার বন্ধ করে দিলেন।

সব জেলা শহরে মাঠ আছে। কিন্তু ক্রিকেটে আঞ্চলিক বোর্ড করা থেকে আপনারা বহু দূরে। ফলে ৬৪ জেলাতেই ক্রিকেট হয়ে আছে স্থবির। পাইপলাইন নাই। অনূর্ধ্ব-১৯ এর ওয়ানডের সাফল্যে আমরা খুশী হই, কিন্তু সেই দলের কেউ যে লিগে এখনো ধারাবাহিক হতে পারছে না, তার কারন খুঁজি না। টেস্ট বা টি-টোয়েন্টিতে রেলিগেশন লিগ বন্ধ করে না হয় নিজেদের বাঁচিয়েছেন- আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, হংকং – এদের সাথে ভয়ে না খেলে নিজেদের দুর্বলতা বাঁচিয়েছেন। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? এই দলকে দিয়ে ধমক দিয়ে, প্লেয়ার বদল করে, হেভী ট্রেইনিং দিয়ে চমক হয়তো দেখানো যাবে, কিন্তু ধারাবাহিকতা পাওয়া সম্ভব না।

আগে ‘এ’ দল অন্য দেশের লিগে খেলতো, এখন তাদের ট্যুর পেতেও কষ্ট হয়। জোর করে নিজেদের স্পন্সর নিয়ে বাইরের দেশে খেলতে হয়, বাংলাদেশের জন্য অন্য দেশ পয়সা ও দিতে চায় না- এটা কি খেয়াল করেছেন? গুজব তো এটাও বলে নিজেরা স্পন্সর করে বলে বাংলাদেশ বিদেশে মাঠও চয়েজ করার চেষ্টা করে।

বাংলাদেশের সব কিছু জাতীয় দল কেন্দ্রিক। তাদের কোচিং নিয়ে কখনো খরচের কমতি ছিল না। কিন্তু মেরে ফেলা হয়েছে পুরো দেশের ক্রিকেটকে। দেশের রিটায়ার্ড এর বয়স সীমা ৬০, আপনার ৬১ হয়ে গিয়েছে (উইকিপিডিয়ায় অনুসারে)। গবেষণা বলে, এই বয়সে নতুন করে কারো কিছু দেয়ার থাকে না। আইবিএ থেকে আপনি অবশ্যই শিখেছেন যে অথোরেটিভ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এখন অচল। আবার কর্পোরেট থেকে এটা ও জানেন কোন কিছু ঠিক না চললে সেই ডিপার্টমেন্ট হেডেরই দোষ, তাদের চলে যেতে হয়।

মুল্যস্ফীতি, সামাজিক অস্থিরতা সব কিছু আমাদের ভুলিয়ে দিতো ক্রিকেট। এখন সেই ক্রিকেট ব্যর্থ। এখন আপনার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত সফলতম বোর্ড সভাপতি থেকেই অন্য রোলে চলে যাবেন, আপনার শ্রদ্ধেয় পিতার মতো সবার শ্রদ্ধাভাজন থাকবেন নাকি জোর করে সব থেকে ব্যর্থ বোর্ড সভাপতি হিসেবে ধিক্কার নিবেন , সিদ্ধান্ত আপনারই। বাংলাদেশের গোল্ড ফিশ মেমোরির জনগন এই বিশ্বকাপের পরই কিন্তু আপনার আগের সাফল্য ভুলে যাবে। ‘হাসান রাজা’ নামটা আসলেই আমাদের জন্য লজ্জা এবং কষ্টের।

লেখক পরিচিতি

ফ্রীল্যান্স অ্যানালিস্ট, সাবেক রিসার্চ ফেলো এবং ক্রীড়া উপস্থাপক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link