২৮ আগস্ট, এশিয়া কাপে মুখোমুখি হয়েছিল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত এবং পাকিস্তান। ভারতের ইনিংসের ১৮তম ওভারের কথা; একদিকে রবীন্দ্র জাদেজা এবং হার্দিক পান্ডিয়া জয়ের জন্য ব্যাট করছিলেন, অন্যদিকে অভিষিক্ত নাসিম শাহ তখন বোলিংয়ে। কিন্তু ১৯ বছর বয়সী এই পেসারের পা জোড়া তখন তাঁর শরীরের ভর বহনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। প্রায় প্রতিটি ডেলিভারি শেষে মাটিতে পড়েছেন তিনি, সেই সাথে মুখে ফুঁটে উঠেছিল তীব্র যন্ত্রণার ছায়া।
কিন্তু মানসিক শক্তির জোরে আবারো উঠে দাঁড়ান নাসিম শাহ। এক পায়ে ভর করে রান আপ নিয়ে বোলিং করেন; স্বাভাবিক গতিতে বলটা করতে পারেননি এই তরুণ, তবু আরো একবার পড়ে যেতে হয়েছে মাটিতে। আগের বারের মত এবারও উঠে দাঁড়িয়েছেন, নিজের কাজটা শেষ করেছেন।
৭ সেপ্টেম্বর, এশিয়া কাপের ফাইনাল নিশ্চিত করার ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল পাকিস্তান। সংযুক্ত আরব আমিরাত এই দুই দেশের অভিবাসীতে পরিপূর্ণ, স্টেডিয়ামেও তাই দর্শকদের গর্জন ছিল সমানে-সমান। আবার পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান দুই দল-ই এই দেশকে নিজেদের দ্বিতীয় হোম ভেন্যু ভাবে। তাছাড়া এই ম্যাচের সাথে ভারতের ভবিষ্যৎ জুড়ে যাওয়ায় দুই প্রতিবেশী দেশের ক্রিকেটীয় দ্বৈরথ নিয়ে আগ্রহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায় ব্যাপক ভাবে।
তবে এই আগ্রহ আর উদ্দীপনা অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায় আফগানিস্তানের ইনিংস শেষে। নির্ধারিত বিশ ওভারে ছয় উইকেট হারিয়ে আফগানিস্তান সংগ্রহ করেছিল মাত্র ১২৯ রান। সময়ের সেরা টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইনআপ পাকিস্তানের, এই লক্ষ্য তাড়া করা তখন সময়ের ব্যাপার মনে হয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে। কিন্তু মাঠে নামতেই দেখা যায় ভিন্ন এক দলকে।
ক্রিকেটের একমাত্র আন্তঃমহাদেশীয় টুর্নামেন্টে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে উন্মুখ হয়ে থাকা আফগানিস্তান মোটেই ছেড়ে কথা বলেনি। ফজল হক ফারুকি, মুজিবুর রহমান, ফরিদ মালিক, রশিদ খান প্রত্যেকে এক যোগে আক্রমণ করেছে বাবর আজমদের ব্যাটিং লাইনআপের উপর। একটা পর্যায়ে মনে হয়েছে পাকিস্তানের তরী বোধহয় ডুবেই গিয়েছে।
শেষ দুই ওভারে যখন জয়ের জন্য আরো ২১ রান প্রয়োজন ছিল, তখনও বাইশ গজে ছিলেন আসিফ আলী। কিন্তু ১৯তম ওভারে একটা ছয় হাঁকানোর পরের বলে এই ফিনিশার আউট হয়ে যান। সেই সাথে নিভে যায় পাকিস্তানের আশার প্রদীপ। পরাজয় মেনে নেয়ার প্রস্তুতিও হয়তো নিয়ে রেখেছিল পাকিস্তানের ড্রেসিং রুম।
সে সময় দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন নাসিম শাহ৷ বোলার নাসিম অবাক করা পারফর্ম করেন ব্যাট হাতে। দশ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে এলেও, তিনি খেলেছেন পুরোদস্তুর কোন ব্যাটারের মতই। শেষ ওভারে যখন জয়ের জন্য এগারো রান প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের, তখন হাতে ছিল মাত্র এক উইকেট।
শেষ ওভারে বল করতে এসেছিল ফজল হক ফারুকি। আগের তিন ওভারে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বাবর আজম, ইনফর্ম মোহাম্মদ নওয়াজ এবং খুশদিল শাহকে আউট করেছিলেন তিনি। তাই হয়তো আগে কখনো আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ব্যাট না করা নাসিম শাহকে বল করতে চাপ অনুভব করেননি এই আফগান পেসার।
দিনের সেরা বোলার বোলিংয়ে, বাইশ গজে নেই কোন স্বীকৃত ব্যাটসম্যান; তবু ঘাবড়ে যাননি নাসিম শাহ। বিশ্বাস রেখেছেন নিজের উপর, ভরসা ছিল নিজের ব্যাটিং সামর্থ্যের উপর। ফজল হক ফারুকি প্রথম বলে ইয়র্কার করতে গিয়ে ফুলটস দিয়েছিলেন; ব্যাটের দুর্দান্ত সুইংয়ে সেই বলে লং অফ দিয়ে উড়িয়ে ছয় আদায় করে নেন তিনি। ওভারের পরের বলেও প্রায় একই দৃশ্য, মনে হবে প্রথম ডেলিভারির রিপ্লে বুঝি।
নাসিম শাহ নিজেও হয়তো বিস্মিত হয়েছিলেন নিজের কীর্তিতে। কিন্তু খাইবার পাখতুনের এই ক্রিকেটারের আরব আমিরাতে খেলতে আসার গল্প এত মধুর নয়। এই গল্পে সংশয় আছে, আছে পতন, সংগ্রাম আর উত্থানের কথা।
যোদ্ধার মত নিজের শেষ শক্তি দিয়ে লড়াই করেও ভারতের বিপক্ষে দলকে জেতাতে পারেননি নাসিম শাহ। জেতাতে না পারার সেই আক্ষেপ হয়তো ভিতরে ভিতরে বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। আর এই আক্ষেপের সমাপ্তি টানার জন্য-ই সম্ভবত আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান ম্যাচের চিত্রনাট্য এভাবেই লিখেছেন বিধাতা।