ক্রিকেটের ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ একটা দলের নাম পাকিস্তান। কখনও নিশ্চিত জেতা ম্যাচে হেরে যাওয়া। আবার কখনও প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে জয় ছিনিয়ে নেওয়া – দু’টি কাজেই সিদ্ধহস্ত দলটি। ক্রিকেটের যুগে অনেক রথী মহারথীর জন্ম দিয়েছে এই দেশটা।
সেই বিখ্যাত মোহাম্মদ পরিবার থেকে শুরু করে হালের বাবর আজম। ৭০-৮০ দশকে এদের সবার থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের এক ক্রিকেটার পেয়েছিল পাকিস্তান। অনেকের মতে তাকে পাকিস্তানের ইতিহাসেরই সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার বিবেচনা করা হয়।
তিনি পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘বড়ে মিয়া’। প্রশ্নসাপেক্ষ সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। পাকিস্তান ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান ও মনে করা হয় জাভেদ মিয়াঁদাদকে। তবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন লেগ স্পিনার হিসেবে। প্রায় দুই দশকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সব সময় প্রতিপক্ষের উপর আধিপত্ত রেখে খেলেছেন।
বাইশ গজে চুল পরিমাণ ছাড় দিতেন না এই পাকিস্তানি ব্যাটিং কিংবদন্তি। তার লেখা আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমি মনে করি, ক্রিকেটটা আমার জন্য ছিল যুদ্ধ। যখন খেলেছি, যুদ্ধ মনে করেই খেলেছি।’
জাভেদ মিয়াঁদাদকে নিয়ে সাবেক অজি অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলের মূল্যায়ন, ‘জাভেদ একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন যদি সে আপনার পক্ষে থাকে আর যদি বিপক্ষ দলের হয়ে থাকে তবে সে হবে আপনার দুচোখের বিষ। মেধা, দক্ষতা, অধ্যবসায় দিয়ে তিনি অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মান অর্জন করেছিলেন।’
সাদা পোশাকে অভিষেক হয় ১৯৭৬ সালে। ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই হাঁকিয়েছিলেন সেঞ্চুরি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে লাহোরের গাদ্দাফী স্টেডিমামে প্রথম ইনিংসে ১৬৩ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে হার না মানা ২৫। পাকিস্তান ম্যাচ জিতে নেয় ছয় উইকেটের ব্যবধানে।
ওই সিরিজের তৃতীয় টেস্টেই তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। করাচিতে সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে ২০৬ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেছিলেন ৮৫ রানের ইনিংস। ক্রিকেটের অভিজাত ফরম্যাটে ১৮৯ ইনিংসে ৫২. ৫৭ গড়ে করেছেন ৮৮৩২ রান। যেখানে ২৩ সেঞ্চুরির বিপরীতে হাফ সেঞ্চুরি আছে ৪৩ টি।
টেস্টে সর্বোচ্চ ডাবল সেঞ্চুরি করা দশজনের একজন তিনি, তাঁর ঝুলিতে আছে ছয়টি ডাবল সেঞ্চুরি। অবসর নেওয়ার সময় দেশের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরির মালিক ছিলেন ‘বড়ে মিয়া’। পরিবর্তীতে এই রেকর্ডটি ইউনুস খানের দখলে চলে যায়।
টেস্টের মত ওয়ানডেতেও প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে বাইশ গজে আধিপত্য চালাতেন। নির্দিষ্ট দিনে যে কোনো বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে তার ব্যাট হয়ে উঠতো যেন খাপখোলা তলোয়ার। অসংখ্য ম্যাচ জেতানো ইনিংস উপহার দিয়েছেন পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই।
ওয়ানডেতে ২৩৩ ম্যাচে ৪১.৭০ গড়ে করেছেন ৭৩৮১ রান। আট সেঞ্চুরির সাথে আছে আট হাফ সেঞ্চুরি। দুই ফরম্যাটেই সমান তালে খেলেছেন। ১৯৯২-এর বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন জাভেদ মিয়াদাঁদ। নয় ম্যাচে করেছিলেন ৪৩৭ রান যা পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতাতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। পরিসংখ্যানই তাঁর বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারের ফিরিস্তি দেয়। যদিও পরিসংখ্যান দিয়ে তার মাহাত্ম্য বুঝানো কঠিন। কেননা পরিসংখ্যানে তো আর লেখা নেই প্রতিপক্ষের উপর কতটা চড়াও হয়ে খেলতেন তিনি।
তবে, একটা ম্যাচের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সালটা ১৯৮৬, ভারতীয় ও অস্ট্রেলিয় দুই উপমহাদেশের সেরা দলগুলো নিয়ে একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল। যার নাম ছিল অস্ট্রালশিয়া কাপ। প্রথমে ব্যাট করে গাভাস্কারের ৯০ আর শ্রীকান্তের ৭৫ রানের উপর ভর করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ভারতের সংগ্রহ ২৪৫ রান। তখনকার ক্রিকেটে এই টার্গেটটা মোটেও সহজ ছিল না।
লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরতেই ব্যাকফুটে পাকিস্তান। ৬১ রানেই হারায় তিন উইকেট। এরপর উইকেটে আসে জাভেদ মিয়াদাদ। এক প্রান্ত আগলে রেখে বলতে গেলে একাই জবাব দিতে থাকেন মিয়াঁদাদ। শেষ ওভারে পাকিস্তানের জিততে দরকার ১১ রান। তখন ও উইকেটে পাকিস্তানের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল মিয়াদাদ।
ম্যাচ গড়ায় শেষ বল পর্যন্ত। শেষ বলে পাকিস্তানের দরকার চার রান আর ভারতের দরকার এক উইকেট। স্ট্রাইকে জাভেদ মিয়াঁদাদ। বোলিং প্রান্তে চেতন শর্মা। উত্তেজনার পারদ ঠাসা ম্যাচে নাটকের শেষ দৃশ্য তখন ও বাকি। সারজার গ্যালারিতে তখন পিন পতন নীরবতা।
শেষ মূহুর্তে উইকেটের চারিদিকে ফিল্ডারদের অবস্থান শেষ বারের মত পরখ নিলেন। শেষ বল নিয়ে ছুটে আসছেন চেতন শর্মা। চেতন শর্মার কোমরের উচ্চতার ফুলটস ডেলিভারি মিড উইকেটের উপর দিয়ে শারজার গ্যালারিতে আছড়ে ফেললেন মিয়াঁদাদ। কমেন্ট্রি বক্স থেকে ভেসে আসছিল, ‘This is six and Pakistan have won. unbelievable victory by Pakistan and Javed Miandad hero of the moment. This is unbelievable.’
১১৪ বলে ১১৬ রানের অতিমানবীয় ইনিংস খেলে ম্যাচের ম্যান অফ দ্য ফাইনাল সেই জাভেদ মিয়াঁদাদ। মাঠে একজন জাভেদ মিয়াঁদাদের উপস্থিতিই ছিল প্রতিপক্ষের জন্য সব চেয়ে বড় থ্রেট। মিয়াদাঁদকে নিয়ে কিংবদন্তি ভিভের মূল্যায়ন, ‘জীবনের জন্য যুদ্ধ করতে আমাকে যদি কোনো ব্যাটসম্যানকে বেছে নিতে হয়, আমি নিবো মিয়াঁদাদকে।’
শেষ করব মাঠের ক্রিকেটে মিয়াঁদাদের নিবেদনের এক ছোট গল্প দিয়ে। ক্রিকেট মাঠে নিবেদিত এক যোদ্ধার নাম জাভেদ মিয়াঁদাদ। মাঠে যেমন নিজের শতভাগ উজার করে দিতেন ঠিক তেমনি সতীর্থদের থেকেও সেরাটা বের করে আনতে চাইতেন সবসময়।
এই ব্যাপারে সাবেক পাকিস্তানের স্পিনার মুশতাক আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমি ডিনারের টেবিলে সব সময় আতঙ্কে থাকতাম কেননা মাঠে কি ভুল করেছি এটা নিয়ে যেকোনো মূহুর্তে মিয়াঁদাদের দিক থেকে মূহুর্তে অভিযোগের তীর আসতে পারে আমার দিকে।’