মারকাটারি ক্রিকেটের বর্তমান যুগে অফস্পিনটা প্রায় বিলুপ্ত। ফ্লাইট কিংবা হাওয়ায় ভাসিয়ে বল করার চাইতে সবার মনোযোগ গতি বাড়ানোর দিকে। তবুও এরাপল্লী প্রসন্ন, শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন, হরভজন সিং পরবর্তী যুগে ভারতের স্পিন বিভাগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন একা হাতে। কখনও মানকাডিং, কখনও বাংলাদেশের পরাজয় কামনা করে টুইট করে ছড়িয়েছেন বিতর্ক। সবকিছু সত্ত্বেও সবাই একবাক্যে মেনে নেন তিনিই সবচেয়ে স্মার্টেস্ট ক্রিকেটার। খেলাটাকে তিনি দেখেন বাকিদের চেয়ে আলাদা চোখে, প্রতিনিয়ত তূণে যোগ করেন নতুন তীর। তিনি রবিচন্দ্রন অশ্বিন।
নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে প্রবেশ করছে বিশ্ব। ক্রমেই উত্থান হচ্ছে শচীন টেন্ডুলকার নামের বিশ্ববালকের। অন্যদিকে, নিজের ক্যারিয়ারের শেষদিকেও সমানতালে রাজত্ব করছেন কপিল দেব। ভারতের প্রতিটা কিশোরই চায় শচীনের মতো ব্যাট হাতে বিশ্ব শাসন করতে কিংবা কপিল দেব হয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলতে। চেন্নাইয়ের ছোট্ট শহর মাম্বালামের বালক রবিচন্দ্রন অশ্বিনও তার ব্যতিক্রম নয়।
সে বন্ধুদের খেলায় ওপেনিং এ ব্যাট করে, বাসায় প্রাকটিস করে তো একবার বাবার নাকই ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেবার হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল অশ্বিনের বাবাকে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে এক সময় ফার্স্ট বোলিং শুরু করে সে। কপিল দেবের মতো ভারতের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে সে বিভোর। তখন কি কেউ জানতো পরবর্তীতে অফ-স্পিনার হয়ে ভারতের জার্সি জড়াবে বছর দশেকের অশ্বিন।
ক্রমেই স্থানীয় ক্রিকেট লিগগুলোতে নিয়মিত মুখে পরিণত হয় কিশোর অশ্বিন। ভালো খেলার সুবাদে মাঝে মাঝেই দূর দূরান্তের টুর্নামেন্টে খেলার ডাক আসত। এমনি এক টুর্নামেন্টের ফাইনালের আগে তাকে কিডন্যাপ করে প্রতিপক্ষ, হুমকি দেয়া হয় ম্যাচ খেললে আঙুল কেটে ফেলবার। ভাগ্যিস হুমকি বাস্তবায়িত হয়নি, নইলে আমারা কিভাবে দেখতুম বোল্ড হয়ে যাওয়ার পর হাশিম আমলার সেই হতবিহ্বল মুখ। ক্রিকেটের পাশাপাশি পড়ালেখাতেও সমান আগ্রহ তাঁর। দেখতে দেখতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পড়ালেখাও শেষ হয়। সময় আসে ক্রিকেট নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
২০১০ আইপিএলে দারুণ পারফর্ম করার সুবাদে ডাক আসে জাতীয় দল থেকে। শ্রীলংকার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ৩৮ রানের পাশাপাশি নেন দুই উইকেট। যদিও সেই ম্যাচে লংকানদের কাছে হেরে গিয়েছিল ভারত। কিন্তু পরাজিত দলে থেকেও আলাদাভাবে সবার নজর কেড়েছিলেন অশ্বিন। পরের বছরই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দলকে সিরিজ জেতাতে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। ডাক আসে বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত দলেও। যদিও সেবার বিশ্বকাপে তেমন একটা সুযোগ পাননি ম্যাচ খেলার।
সে বছরেরই শেষদিকে শচীন টেন্ডুলকারের বিদায়ী টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নয় উইকেট নিয়ে রাঙিয়ে তোলেন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কেবল ঘরের মাঠের স্পিনার হিসেবে সমালোচিত ছিলেন অশ্বিন। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে খুব বাজে সময় কাটান। কর্ণ শর্মা, প্রজ্ঞান ওঝা, শাহবাজ নাদিম, রবীন্দ্র জাদেজার উত্থানে বুঝতে পারেন সময় এসেছে বোলিং নিয়ে কাজ করার। এরপরই বিশ্ব ক্রিকেটে দেখা মিলে নতুন এক অশ্বিনের।
বোলিং নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। কখনও ক্যারম বল কিংবা দুসরা, আবার কখনও চেষ্টা চালিয়েছেন লেগ স্পিন আয়ত্ত্বের। ফলাফল পেতেও সময় লাগেনি, দ্রুততম ভারতীয় বোলার হিসেবে ছুঁয়েছেন টেস্টে ৪০০ উইকেটের মাইলফলক। ক্ল্যারি গ্রিমেটের পর তাঁর চেয়ে দ্রুততম সময়ে কেউ ছুঁতে পারেনি দুশো উইকেটের ল্যান্ডমার্ক। উইকেট সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫০ হিসেবে নিলে তিনিই হয়ে যান সর্বকালের সবেচেয়ে দ্রুততম।
এ বছরেরই মার্চে উইকেট সংখ্যায় ছাপিয়ে গেছেন কপিল দেবকেও। অশ্বিনের মাহাত্ন্য আসলে কেবলে উইকেট সংখ্যায় নয়। মৃতপ্রায় অফস্পিনকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন। “ধর তক্তা মার পেরেক” এই নীতিতে যখন এগিয়েছে ক্রিকেট, তখনই তিনি সবাইকে বাধ্য করেছেন আলাদা করে ভাবতে। কখনও মানকাড বিতর্কে জড়িয়েছেন, আবার কখনও দলের স্বার্থে ইচ্ছা করে আউট হয়ে সুযোগ দিয়েছেন ভিন্নভাবে ভাববার।
কেবল লাল বলের ক্রিকেট নয়, সাদা বলের ক্রিকেটেও সমান সাবলীল অশ্বিন। ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে শেষ ওভারে বল করে জয় এনে দিয়েছিলেন ভারতকে। ১১ পরবর্তী দু’টি বিশ্বকাপেই ছিলেন ভারতীয় দলের নিয়মিত মুখ। মাঝে লেগস্পিনের উত্থানে দল থেকে বাদ পড়েছিলেন, কিন্তু নিজের কার্যকারিতার প্রমাণ দিয়ে দলে ফিরেছেন দ্রুতই। আইপিএলে বড় একটা সময় ছিলেন চেন্নাই সুপার কিংসের অংশ।
দু’বার জিতেছেন আইপিএলের শিরোপা। মাঝে দিল্লি ক্যাপিটালস, পাঞ্জাব কিংসের অধিনায়কত্ব করলেও বর্তমানে থিতু হয়েছেন রাজস্থান রয়্যালসে। হরভজন সিংহের পর দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে স্পর্শ করেছেন আইপিএলে ১৫০ উইকেটের মাইল ফলক। বোলিংয়ের পাশাপাশি ছোটবেলার ব্যাটিংটাকেও ভুলে যাননি। যখনই দলের প্রয়োজন হয়েছে, ব্যাট হাতে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরেই স্টার্ক, কামিন্স, হ্যাজলউডদের সামলে দলকে এনে দিয়েছিলেন জয়ের সমান ড্র।
ক্রিকেট মাঠে তার মতো করে মস্তিষ্কটাকে আর কেউ ব্যবহার করতে পারেননি। বয়সটা হয়ে গেছে ৩৬, মেরেকেটে হয়তো আরও বছর তিনেক খেলবেন। কিন্তু আজ থেকে বহু বছর পরেও ক্রিকেটবিশ্ব তাকে মনে রাখবে বাইশ গজের সবেচেয়ে স্মার্ট ক্রিকেটার হিসেবেই।