শিল্প বিপ্লবের অবসান

জন্ম ও মৃত্যুর মত জীবনের আরেকটি সত্যকে এড়ানো যায় না। প্রিয় ক্রীড়া তারকার অবসর। যে কোন ক্রীড়াবিদের কর্মজীবন ভীষণ সংক্ষিপ্ত। তাই যখন আপনি আপনার অজান্তেই কোন স্পোর্টস-পার্সনের দক্ষতা বা সৃষ্টিশীলতার ভক্ত হয়ে পড়েন ঠিক তখনই আপনি জেনে যান যে বিচ্ছেদের আবেগঘণ মুহূর্ত আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে রাস্তার বাঁকে। সেই ভবিষ্যৎ বিরহের কালো মেঘকে উপেক্ষা করেও আপনি ভালবাসেন, কারণ ক্ষণিকের পূর্ণতাও আপাত অর্থহীন জীবনযাত্রাকে অর্থবহুল করে রাখার ক্ষমতা রাখে।

সুইস টেনিস তারকা রজার ফেদেরার ঠিক সেরকমই এক ক্রীড়াবিদ হয়ে বহু মানুষের জীবনে প্রবেশ করেছিলেন। ২০০১ সালে যেদিন তিনি উইম্বল্ডনের ঘাসের কোর্টের ততকালীন বেতাজ বাদশা পিট সাম্প্রাসকে মহাকাব্যিক লড়াই এ পরাভূত করেন সে সময়ে তাঁর মাথায় পনিটেল, তাঁর টেনিস- সৌন্দর্য সম্পূর্ণ হওয়ার যাত্রাপথে। তাও সেদিনই ফেদেরার লক্ষ মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন এক নিমেষেই। আর ফেরত দেননি।

শোনা যায় ২০০৯ সালে প্রথম ফেদেরার অবসর নেওয়ার কথা পরিকল্পনা করেন। আমরা ভাগ্যবান তার পরও এত বছর রজার টেনিস কোর্টে থেকে গেলেন। শেষের দিনগুলোতে চোট-আঘাতে জর্জরিত ফেডারারকে কুরুক্ষেত্রের কর্ণের মতন লাগত। চাকাটা বসে গেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন আরও একবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরার, অর্জুনসম নাদাল ও জকোভিচের বিরুদ্ধে আরও একবার নিজেকে পরখ করার জন্য।

তবে রজার শুধু নিজের জন্য বা তাঁর পরিবার, বিশেষ করে স্ত্রী মিরকার জন্য কোর্টে ফিরতে চাইতেন মনে হয় না, তিনি আমাদের মতন বহু অনামী, অখ্যাত ভক্তের জন্যও খেলে যেতে চাইতেন, চাইছিলেন। কারণ রজার যে সেই তাজা বাতাস হিসেবে আমাদের জীবনে এসেছিলেন যিনি পাওয়ার টেনিসের সাম্রাজ্যে শিল্প ফিরিয়ে আনা এক ব্যতিক্রমী যাদুকর ছিলেন।

জকোভিচ বা নাদালের খেলা কি দেখতে ভাল লাগে না? নিশ্চয় লাগে। জোকার যখন স্লাইড করে এসে ব্যাকহ্যান্ড মারেন, বা নাদাল দৌড়তে-দোউড়তেই ডাউন দ লাইন ফোরহ্যান্ড উইনার খেলেন, তখন টেনিসপ্রেমীর হৃদয় কুর্নিশ জানাতে বাধ্য।

কিন্তু ফেডারার যে টেনিস কোর্টে চলমান ব্যালে ডান্সার ছিলেন। এ কথা আমার নয়, বিখ্যাত ফ্যাশন ফোটোগ্রাফার রাদকা লিট্মেরিটজ-এর। যিনি র‍্যাম্প ছেড়ে রজারের ছবি তুলতে টেনিস কোর্টে পৌঁছে যেতেন।

ফেদেরারের খেলা দেখলে মনে হত একটি আশ্চর্য ভাস্কর্য যেন চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে, পুরোটাই জল দিয়ে তৈরি। তার এক-হাতের ব্যাকহ্যান্ড, বুদ্ধিদীপ্ত ফোরহ্যান্ড , চোখ-জুড়িয়ে যাওয়া ড্রপ-শট, বা নেটের গায়ে দাঁড়িয়ে মারা অপরুপ ভলি আর দেখতে পাওয়া যাবে না। এই সমস্ত শটগুলিই অন্য তারকারা মারবেন, মেরে যাবেন যতদিন টেনিস থাকবে, কিন্তু সেগুলি ফেডারারের মতন হবে না। এটাই ফেদেরার।

কিন্তু তিনি শুধু শিল্পী ছিলেন না। শিল্পের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন জেতার মানসিকতা। যাকে ক্রীড়া পরিভাষায় বলা হয় উইনিং মেন্ট্যালিটি। একটা যুগ ছিল যখন টেনিস দুনিয়া ছিল ফেদেরারময়, সমস্ত গ্র্যান্ড-স্ল্যাম, সমস্ত বর মাস্টার্সে ফেদেরার যুগ তখন, একমাত্র ক্লে কোর্টে নাদাল তাঁর রাজত্ব কায়েম রেখেছেন। এই সময়ই রজার তাঁর বেশীরভাগ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেন।

বিশ্বের এক নম্বর পুরুষ টেনিস তারকা থাকেন ২৩৭ সপ্তাহ। উইম্বল্ডনের সবুজ ঘাসকে নিজের বাড়ির উঠান বানিয়ে ফেলেন। তবে এর মধ্যেও ছন্দপতন ঘটে মহাকাব্যিক রুপে, ২০০৮-এর বিখ্যাত উইম্বল্ডন ফাইনালে। সেই রাফা যিনি আবেগতাড়িত একটি টুইট করেন কাল দেডারার অবসর ঘোষণা করার পর, তিনিই উইম্বল্ডনের সেন্টার কোর্টে রজার কে পরাভূত করেন সে দিন।

কিন্তু তারপরও বারবার ফিরে আসেন রজার। ৩৬ এ পৃথিবীর এক নম্বর হন আবার। ৩৭এ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতেন। তাঁর টিকে থাকার ক্ষমতার জন্যই এক সময় তাঁকে জাদুকর লাগতে শুরু করেছিল।

একটা সময় গোট কে, রজার, রাফা না নোভাক এই নিয়ে ভীষণ তর্ক শুরু হয়েছিল। (এখনও চলবে।) মাপার নিরিখ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের সংখ্যা। ফেডারার ২০তে ছিলেন, থেকে গেলেন। নাদাল ২২এ চলে গেছেন। জকোভিচ ২১এ থাকলেও মনে হচ্ছে তিনিই শেষ হাসিটা হাসবেন একদিন।

দুইয়ের থেকেই বয়েসে বড় অগ্রজ রজার খেলা ছেড়ে দিয়ে যেন বলে দিলেন, থাক তোরা নম্বরের লড়াই নিয়ে, আমাকে মাপতে পরিসংখ্যানের বাইরে যেতে হয়, শিল্পের আঙ্গিনায় ঢুকতে হয়। এটাই আমার লেগ্যাসি। সেই শিল্প বিপ্লব শেষ হয়ে গেল কাল, শক্তির আঙ্গিনায় যা ছিল ব্যাতিক্রম, বহু মানুষের বেঁচে থাকার রসদ। কিন্তু সেই স্মৃতিগুলো থেকে গেল, রসদ হিসেবে সেগুলিই বা কম কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link